সালাতুর রাসূল (সা:)-(পর্ব-৮)
---------------------------------------
সর্বাবস্থায় সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা:
--------------------------------------------------------
বিরোধীদের দলীলসমূহ ও তার জওয়াব:
------------------------------------------------------
ইমামের পিছনে জেহরী বা সের্রী কোন প্রকার ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা যাবে না -এই মর্মে যাঁরা অভিমত পোষণ করেন, তাঁদের প্রধান দলীল সমূহ নিম্নরূপ:
(১) সূরা আ‘রাফ ২০৪ আয়াতে ক্বিরাআতের সময় চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে তা শুনতে বলা হয়েছে। সেখানে বিশেষ কোন সূরাকে ‘খাছ’ করা হয়নি। এক্ষণে হাদীস দ্বারা সূরায়ে ফাতিহাকে খাছ করলে তা কুরআনী আয়াতকে ‘মনসূখ’ বা হুকুম রহিত করার শামিল হবে। অথচ ‘হাদীস দ্বারা কুরআনী হুকুমকে মানসূখ করা যায় না’। [নূরুল আনওয়ার ২১৩-১৪ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ৩/৬৭ পৃঃ।]
জবাব : এখানে ‘মানসূখ’ হবার প্রশ্নই ওঠে না। বরং হাদীসে ব্যাখ্যাকারে বর্ণিত হয়েছে এবং কুরআনের মধ্য থেকে উম্মুল কুরআনকে ‘খাছ’ করা হয়েছে (হিজর ১৫/৮৭)। যেমন কুরআনে সকল উম্মতকে লক্ষ্য করে ‘মীরাছ’ বণ্টনের সাধারণ আদেশ দেওয়া হয়েছে (নিসা ৪/৭,১১)। কিন্তু হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারী সন্তানগণ পাবেন না বলে ‘খাছ’ ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِيْ وَالْقُرْآنَ الْعَظِيْمَ ‘আমরা আপনাকে দিয়েছি সাতটি আয়াত (সূরা ফাতিহা), যা পুন: পুন: পঠিত হয় এবং মহান কুরআন’ (হিজর ১৫/৮৭)। রাসুলুল্লাহ (সা:), إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ لاَ نُورَثُ مَا تَرَكْنَاهُ صَدَقَةٌ ‘আমরা নবীগণ! কোন উত্তরাধিকারী রাখি না। যা কিছু আমরা রেখে যাই, সবই ছাদাক্বা’। =কানযুল উম্মাল হা/৩৫৬০০; নাসাঈ কুবরা হা/৬৩০৯; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৭৬ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, অনুচ্ছেদ-১০।]
মূলতঃ রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর আগমন ঘটেছিল কুরআনের ব্যাখ্যাকারী হিসাবে [নাহল ১৬/৪৪, ৬৪।] এবং ঐ ব্যাখ্যাও ছিল সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট।[নাজম ৫৩/৩-৪ وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى, ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯ ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ ।] অতএব রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর প্রদত্ত ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করা ‘অহিয়ে গায়ের মাতলু’ বা আল্লাহর অনাবৃত্ত অহি-কে প্রত্যাখ্যান করার শামিল হবে।
(২) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা এক জেহরী ছালাতে সালাম ফিরিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা:) মুছল্লীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এইমাত্র আমার সাথে কুরআন পাঠ করেছ? একজন বলল, জি-হাঁ। রাসুলুল্লাহ (সা:) বললেন, তাই বলি, مَا لِيْ أُنَازِعُ القُرْآنَ ‘আমার ক্বিরাআতে কেন বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে’? রাবী বলেন,- فَانْتَهَى النَّاسُ عَنِ الْقِرَاءَةِ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْمَا جَهَرَ فِيْهِ ‘এরপর থেকে লোকেরা জেহরী ছালাতে রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর সাথে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হ’ল’।[আবুদাঊদ, নাসাঈ, তিরমিযী , মিশকাত হা/৮৫৫, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।]
জবাব : হাদীছের বক্তব্যে বুঝা যায় যে, মুক্তাদীগণের মধ্যে কেউ রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর সাথে সাথে সরবে ক্বিরাআত করেছিলেন। যার জন্য ইমাম হিসাবে রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। ইতিপূর্বে আনাস ও আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ দু’টিতে নীরবে পড়ার কথা এসেছে, যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন,فَإنْ قَرَأَ فَلْيَقْرَءِ الْفَاتِحَةَ قِرَاءَةً لاَ يُشَوِّشُ عَلَي الْإِمَامِ- ‘জেহরী ছালাতে মুক্তাদী এমনভাবে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করবে, যাতে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়’।[হুজ্জাতুল্লা-হিল বা-লিগাহ (কায়রো : দারুত তুরাছ ১৩৫৫/১৯৩৬), ২/৯ পৃঃ।]
অতএব নীরবে ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পড়লে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টির প্রশ্নই আসে না। উল্লেখ্য যে, হাদীসের শেষাংশে ‘অতঃপর লোকেরা ক্বিরাআত থেকে বিরত হ’ল’ কথাটি ‘মুদরাজ’ (مدرج), যা সনদভুক্ত অন্যতম বর্ণনাকারী ইবনু শিহাব যুহরী কর্তৃক সংযুক্ত। শিষ্য সুফিয়ান বিন ‘উয়ায়না বলেন, যুহরী (এ বিষয়ে) এমন কথা বলেছেন, যা আমি কখনো শুনিনি’। [আবুদাঊদ হা/৮২৭; আওনুল মা‘বূদ হা/৮১১-১২, অনুচ্ছেদ-১৩৫; নায়লুল আওত্বার ৩/৬৫।]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّمَا جُعِلَ الْإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوْا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوْا- ‘ইমাম নিযুক্ত হন তাকে অনুসরণ করার জন্য। তিনি যখন তাকবীর বলেন, তখন তোমরা তাকবীর বল। তিনি যখন ক্বিরাআত করেন, তখন তোমরা চুপ থাক’। [আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৮৫৭।]
জবাব: উক্ত হাদীসে ‘আম’ ভাবে ক্বিরাআতের সময় চুপ থাকতে বলা হয়েছে। কুরআনেও অনুরূপ নির্দেশ এসেছে (আ‘রাফ ৭/২০৪)। একই রাবীর (আবু হুরায়রা) ইতিপূর্বেকার বর্ণনায় এবং আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে সূরায়ে ফাতিহাকে ‘খাছ’ ভাবে চুপে চুপে পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব ইমামের পিছনে চুপে চুপে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করলে উভয় ছহীহ হাদীসের উপরে আমল করা সম্ভব হয়।
(৪) হযরত জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الْإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ ‘যার ইমাম রয়েছে, ইমামের ক্বিরাআত তার জন্য ক্বিরাআত হবে’।[ইবনু মাজাহ হা/৮৫০; দারাকুৎনী হা/১২২০; বায়হাক্বী ২/১৫৯-৬০ পৃঃ; হাদীছ যঈফ।]
জবাব : (ক) ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, যতগুলি সূত্র থেকে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সকল সূত্রই দোষযুক্ত। সেকারণ ‘হাদীসটি সকল বিদ্বানের নিকটে সর্বসম্মতভাবে যঈফ (إِنَّهُ ضَعِيْفٌ عِنْدَ جَمِيْعِ الْحُفَّاظِ)’।[ফাৎহুল বারী ২/২৮৩ পৃঃ, হা/৭৫৬ -এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; নায়লুল আওত্বার ৩/৭০ পৃঃ। আলবানী হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। অতঃপর ব্যাখ্যায় বলেন যে, হাদীসটির কোন সূত্র দুর্বলতা (ضعف) হ’তে মুক্ত নয়। তবে দুর্বল সূত্র সমূহের সমষ্টি সাক্ষ্য দেয় যে, এর কিছু ভিত্তি আছে (أن للحديث أصلا) (ইরওয়া হা/৫০০, ২/২৭৭)। তাঁর উপরোক্ত মন্তব্যই ইঙ্গিত দেয় যে, হাদীসটি আসলেই যঈফ, যা অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ সর্বসম্মত ভাবে বলেছেন।] (খ) অত্র হাদীসে ‘ক্বিরাআত’ কথাটি ‘আম’। কিন্তু সূরায়ে ফাতিহা পাঠের নির্দেশটি ‘খাছ’। অতএব অন্য সব সূরা বাদ দিয়ে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করতে হবে।
মন্তব্য এবং আমাদের করণীয়:
----------------------------------------
অতএব, উপরোক্ত জাল, জয়ীফ এবং সহিহ হাদীসগুলোর পর্যালোচনা শেষে এটুকু বলা যায় যে, সকল প্রকার সালাতের প্রতি রাকআতে অবশ্যই সুরা ফাতেহা পড়তেই হবে। হোক সেই সালাত একাকী অথবা ইমামের পেছনে। বিভিন্ন যুক্তি, জাল-জয়ীফ হাদীস পেশ করে এই আমল থেকে বিরত থাকাটা হবে চরম পাপের কাজ। শুধু তাই নয় সুরা ফাতেহা পাঠ না করলে আমাদের সালাত ও শুদ্ধ হবেনা।
No comments:
Post a Comment