Sunday, April 5, 2015

ফরয নামাযের ইক্বামত হওয়ার পরে অন্যকোন নামায পড়া নিষেধ-




ফরয নামাযের ইক্বামত হওয়ার পরে অন্যকোন নামায পড়া নিষেধ-
ইন্নালহামদুলিল্লাহ। যাবতীয় প্রশংসা ও গুনগান একমাত্র,শুধু মাত্র আল্লাহর জন্য। সালাত ও সালাম প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর পরিবার ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অধিকাংশ নামাযীদেরই দেখা যায় যে, মসজিদে বিলম্বে আসার কারণে, ফযরের নামাযের ইক্বামত হয়ে যাওয়ার পরও তারা ফযরের সুন্নাত নামায পড়তে শুরু করেন।
এমন কি ফযরের ফরয নামাযের অধিকাংশ অতীত হওয়ার পরও যদি কেউ আসেন, তবুও তাৎক্ষণিকভাবে জামা'আতে শরীক না হয়ে সুন্নাত নামাযটুকু আগে পরে নেয়ার চেষ্ঠা করেন। আবার অনেককে এমনও দেখা যায় যে, ইমাম সাহেব নামায দু'রাকা'আত শেষ করে 'আত্তাহিয়্যাতু' পড়ছেন, তবুও ঐ নামাযী সুন্নাত পড়তে আরম্ভ করেন।
রাসুল (সাঃ) এর হাদীস এবং নামাযের সঠিক মাস'আলা না জানার কারণেই তারা এমনটি করে থাকেন। রাসুল (সাঃ) এর হাদীসের পরিপন্থী এ আমলের জন্য এসকল অনভিজ্ঞ সাধারণ নামাযীরাই শুধু দায়ী নন। এর জন্য সংশ্লিষ্ট মসজিদসমূহের ইমাম সাহেবগণও দায়ী।
কেননা এসম্পর্কে রাসু (সাঃ) এর হাদীস এবং ফিকহের সঠিক মাসা'আলা তাদের বুঝিয়ে দেয়া ছিল ইমাম সাহেবদের দায়ীত্ব।
''রাসুল (সাঃ) এর কয়েকটি হাদীস'' এ সম্পর্কে নিম্নে রাসুল (সাঃ) এর কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো- (১) হাদীসঃ আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন। নবী (সাঃ) বলেন, '' নামাযের ইক্বামত হয়ে গেলে; ফরয নামায ছাড়া আর কোন নামায নেই।''
[সিহীহ মুসলিম ৭১০, আবু দাউদ ১২৫২, তিরমিযী ৪১৯, নাসায়ী ১১৭, ইবনে হিব্বান ৬/২৪৭০, সহীহ ইবনে খুযাইমা ১১২৩, এবং মুসনাদে আহমদ ২/৫১৭ পৃষ্ঠা ইত্যাদি]
(২) হাদীসঃ বুহাইনা (রাঃ) এর পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে মালিক থেকে বর্ণিত। সকালের নামাযের ইক্বামত হওয়ার পর রাসুল (সাঃ) এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, সে নামায পড়ছিল। অতঃপর রাসুল (সাঃ) তাকে কিছু বললেন। তবে তিনি তাকে কি বললেন; আমরা তা বুঝতে পারি নি। এরপর আমরা এগিয়ে তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুল (সাঃ) তোমাকে কি বলেছেন? সে বলল, রাসুল (সাঃ) আমাকে বলেছেন, তোমাদের কেউ ভোরের নামায চার রাকা'আত পড়তে শুরু করবে? [সহীহ মুসলিম ৭১১]
(৩) হাদীসঃ ইবনে বুহাইনা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সকালের নামাযের ইক্বামত হলে রাসুল (সাঃ) এক ব্যক্তিকে নামায পড়তে দেখলেন। আর মুয়াযযিন তখনও ইক্বামত বলছিল। তখন রাসুল (সাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি সকালের নামায চার রাকা'আত পড়ছো? [সহীহ মুসলিম ৭১১] অর্থাৎঃ রাসুল (সাঃ) এর কথা তুমি কি সকালের নামায চার রাকা'আত পড়ছো? এটা অস্বীকৃতিমূলক প্রশ্ন। এর অর্থ হচ্ছে; ফযরের নামাযের ইক্বামত হওয়ার পর উক্ত ফরয নামায ছাড়া অন্যকোন নামায পড়া শরীয়তসম্মত নয়। অতএব ঐ ব্যক্তি যখন ইক্বামতের পরে দু'রাকা'আত ফযরের সুন্নাত নামায পড়ল, অতঃপর মুসল্লিদের সাথে আবার ফরয পড়লো; তাহলে এর অর্থ দাঁড়ালো যে, সে ভোরের নামায চার রাকা'আত পড়েছে। কেননা সে ইক্বামতের পরে নামায পড়েছে চার রাকা'আত। [সহীহ মুসলিম, বিশারহিন নববী ৫/৭১১]
(৪) হাদীসঃ হাফস ইবনে আসিম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আযদ গোত্রের এক ব্যক্তি যাকে মালিক ইবনে বুহাইনা বলে ডাকা হয়; আমি তাকে বলতে শুনেছি যে, (ফজরের) নামাযের ইক্বামত শুরু হওয়ার পর রাসুল (সাঃ) এক ব্যক্তিকে (ফজরের) দু'রাকা'আত সুন্নাত নামায পড়তে দেখলেন। অতঃপর রাসুল (সাঃ) তার কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর লোকেরা তাকে ঘিরে ধরলো। আর রাসুল (সাঃ) তাকে বলছিলেন, সকালের নামায কি চার রাকা'আত? সকালের নামায কি চার রাকা'আত? [সহীহ বুখারী ৬৬৩]
(৫) হাদীসঃ আবু মুলাইকা ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, (একবার) ফজরের নামাযের ইক্বামত শুরু হয়ে গেল। আর আমি ইতোপূর্বে এর সুন্নাত দু'রাকা'আত পড়তে না পারায়; তা পড়তে শুরু করলে রাসুল (সাঃ) জোর করে টেনে আমাকে তা থেকে বিরত রাখলেন এবং বললেন, সকালের নামায কি তুমি চার রাকা'আত পড়তে চাও? আবু আমর অর্থাৎ সালেহ ইবনে রুসতুমকে (উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারী) জিজ্ঞেস করা হলো। এমনি নবী (সাঃ) করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ (তিনি এমনটি করেছেন) [সহীহ ইবনে খযাইমা ২/১১২৪]
(৬) হাদীসঃ আব্দুল্লাহ ইবনে সারজিস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) এক সকালে নামায পড়া অবস্থায় এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে এর এক পাশে ফজরের দুই রাকা'আত সুন্নাত নামায পড়ছিল। তার নামায দুই রাকা'আত শেষ করে সে রাসুল(সাঃ) এর সাথে জামা'আতে শরীক হলো। অতঃপর রাসুল(সাঃ) নামায থেকে সালাম ফিরিয়ে বললেন, 'হে অমুক! দুই নামাযের কোনটি তুমি (ফরয নামায হিসেবে) গ্ণ্য করেছো? তোমার একাকী পড়া নামাযকে, না আমাদের সাথে পড়া নামাযকে? [সহীহ মুসলিম ৭১২]
(৭) হাদীসঃ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ভোরের নামাযের ইক্বামত হওয়ার পর আমি এর দু;রাকা;আত (সুন্নাত) নামায পড়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালাম। অতঃপর নবী (সাঃ) আমার হাত ধরে বললেন, তুমি কি ফজরের নামায চার রাকা'আত পড়ছো?
[ইবনে হিব্বান ৬/২৪৬৯]
উল্লেখিত হাদীসসমূহ থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল যে, ইক্বামত হয়ে যাওয়ার পর কোন অবস্থাতেই ফজরের সুন্নাত নামায পড়া যাবে না। হদীসে ফজরের সুন্নাত নামাযের বিশেষ মর্যাদা দেয়া সত্ত্বেও ইক্বামত হয়ে যাওয়ার পর যেহেতু তা পড়তে নিষেধ করা হয়েছে সেহেতু অন্যকোন ওয়াক্তের সুন্নাতও এর ফরযের ইক্বামতের পর অবশ্যই পড়া যাবে না। ''ইক্বামত হয়ে গেলে সুন্নাত না পড়ার রহস্য'' এর রহস্য সম্পর্কে ইমাম নববী (রহঃ)
লিখেছেন- কাজী আয়ায বলেন, ইক্বামত শুরু হওয়ার পর সুন্নাত এবং নফল নামায নিষিদ্ধ হওয়ার হিকমত বা রহস্য হচ্ছে এই ইক্বামতের পরে সুন্নাত নামায পড়ার অবকাশ দেয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে একে ওয়াজেব বলে মনে করা হবে। তবে এ কথাটি দুর্বল, বরং সঠিক কথা হচ্ছে, নামাযী প্রথম থেকেই ফরয নামাযের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকবে এবং ইমামের শুরু করার পরেই সে নামায শুরু করবে। পক্ষান্তরে ইক্বামতের পরে সে যদি সুন্নাত পড়তে ব্যস্ত হয়ে যায় তাহলে ইমামের সাথে তাকবীরে তাহরীমা ও ফরয নামাযের পূর্ণতা বিধানকারী কিছু অংশ তার থেকে ছুটে যাবে। সুতরাং ফরয নামাযের পূর্ণতার সংরক্ষণ করাই উত্তম। কাজী আয়ায এতে অন্য আরেকটি রহস্যের কথাও বলেছেন যে, এতে ইমামদের বিরুদ্ধে অনৈক্য সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে।
[শারহুন নববী ৫/৭১১]
সুন্নাত নামাযে ব্যস্ত ব্যক্তির প্রতি ইবনে উমরের পাথর নিক্ষেপ'' ইক্বামতের পর সুন্নাত নামায না পড়ার ব্যাপারে ইবনে উমর (রাঃ) এত কঠোর ছিলেন যে, একবার তিনি ফজরের নামাযের ইক্বামতের পরে এক ব্যক্তিকে ফজরের সুন্নাত পড়তে দেখে পাথর নিক্ষেপ করে তাকে আঘাত করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে এটা ছিল নিকৃষ্ট বিদ'আত। এ জন্যই ছোট ছোট পাথর নিক্ষেপ করে তিনি ঐ ব্যক্তিকে তা থেকে বিরিত রাখার চেষ্টা করছিলেন। এ কারণেই ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহঃ) ইবনে উমর (রাঃ) এর বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাটি নিম্নরূপ - ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, মুয়াযযিন ফজরের নামাযের ইক্বামত দিচ্ছিল, এমনি অবস্থায় তিনি এক ব্যক্তিকে এর দু;রাকা'আত সুন্নাত নামায পড়তে দেখে তার প্রতি ছোট ছোট পাথর নিক্ষেপ করছিলেন, আর বলছিলেন, সকালের নামায কি তুমি চার রাকা'আত পড়ছো? এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) লিখেছেন- ''বরং নবী (সাঃ) থেকে বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, 'ফরয নামাযের ইক্বামত হয়ে গেলে আর কোন নামায নেই।' অন্য বর্ণনায় এসেছে, 'ইক্বামত হয়ে গেলে যে নামাযের ইক্বামত হয়েছে সে নামায ছাড়া অন্য কোন নামায নেই।' অতএব নামাযের ইক্বামত হয়ে গেলে কোন ব্যক্তি সুন্নাত-নফল নামায দ্বারাই মসজিদকে ব্যস্ত রাখতে পারবে না। আলিমগণ একথার ওপর ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, ইক্বামত হওয়ার পর 'তাহইয়্যাতুল মসজিদ' নামায দ্বারা ফরয নামায থেকে কেউ বিরত থাকতে পারে না। তবে ফজরের সুন্নাত নাযের ব্যাপারে তাদের মতভেদ রয়েছে। তবে সঠিক কথা হচ্ছে কেউ ইক্বামত শোনার পর নিজের ঘরে অথবা অন্য কোথাও সুন্নাত নামায পড়বে না। হ্যাঁ ইচ্ছা করলে উক্ত সুন্নাত নামায ফরয পড়ার পরেও পড়তে পারে। [আল ফাতাওয়া আল কুবরা ১/১৪২, শাখুল ইসলাম তাকী উদ্দিন ইবনে তাইমিয়া]
সংশ্লিষ্ট মাস'আলায় হানাফী ফকীহ ইমাম কাসানী (রহঃ) লিখেছেন ইক্বামত হয়ে যাওয়ার পর মসজিদে ফজরের সুন্নাত নামায সহ সকল প্রকার নামায পড়াকে নিষিদ্ধ মনে করেন। ইমাম কাসানী (রহঃ) লিখেছেন- মুয়াযযিনের ইক্বামত শুরু করার সময় কেউ যদি মসজিদে প্রবেশ করে; তবে তার জন্য সুন্নাত-নফল নামায পড়া মাকরুহ। এই নামায চাই ফজরের সুন্নাতই হোক বা অন্য কোন নফল নামায। কেননা সে জামা'আতে নামাযের পরওয়া করছে না বলে নিজেকে অভিযুক্ত করছে। অথচ নবী (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে অবশ্যই অভিযোগের স্তরে অবস্থান করবে না।
[ বাদাইউস সানাই ১/৬৩৯ পৃষ্ঠা, ইমাম কাসানী এবং আলবাহর আররাইক্ব ২/১৩০]
ফওত হয়ে যাওয়া ফজরের সুন্নাত নামায ফরয নামাযের পরে অথবা সূর্য ওঠার পর দ্বীপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে। অন্যান্য ফরয নামাযের সুন্নাত ও ফরয নামাযের পরে পরা যাবে তা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ আমাদের সকল প্রকার মতামত ও মতভেদ থেকে রাসুল (সাঃ) স্পষ্ট প্রমানিত হাদীসের দিকে ফিরে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমিন। [সুত্রঃ নামাযে প্রচলিত ভুল মাসায়েলের তাত্বিক পর্যালোচনা, ৭৯, ৮০, ৮১, ৮২, ৮৩, ৮৪, ৮৫, পৃষ্ঠা; লেখকঃ আব্দুল হাফীজ পাঠান]

No comments:

Post a Comment