Thursday, June 11, 2015

রমাযান মাসের বৈশিষ্ট্য ও তার রোযারমাহাত্ম্য


itsaboutislam.com's photo.

আসসালামু আলাইকুম
রমাযান মাসের বৈশিষ্ট্য ও তার রোযারমাহাত্ম্য
রমাযান শব্দটি ‘রম্য’ ধাতু থেকে উৎপত্তি। এর মানে হল কঠিন গরম, জ্বালিয়ে দেওয়া। চান্দ্র মাস গুলোর যখন প্রাচীন নাম বাদ দিয়ে আরবী ভাষায় নতুন নাম দেওয়া হয়, তখন রমাযান মাসটি পরে কঠিন গরমের সময়। আর তাকেই ভিত্তি করে তার ‘রামাযান’ নামকরণ করা হয়। অবশ্য রমাযান মাসের রোযা ফরয হওয়ার পর তার নাম সার্থক হয়। যেহেতু উক্ত মাসে ক্ষুৎ পিপাসায় রোযাদারের পেট জ্বলে থাকে।
রমাযানের মাসের একাধিক এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্যান্য মাসে নেই।যেমন ঃ-
১। এই মাসের নাম কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে।
(দ্রষ্টব্য কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
পক্ষান্তরে অন্য মাসের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
২। এই মাস আসার সময় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাহাবাগণকে সুসংবাদ দিতেন।
৩। রমাযান হল বর্কতময় পবিত্র মাস। এ মাসে বর্কত অবতীর্ণ হয়।
৪। মহান আল্লাহ এই মাসের রোযা ফরয করেছেন।
৫। এই মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করা হয় এবং একটা দ্বারও বন্ধ থাকে না।
৬। এই মাসে রহমতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়।(সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৩০৭, সহীহুল জামেইস সাগীর,আলবানী ৪৭১নং)
৭। এই মাসে জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করা হয় এবং একটা দ্বারও খোলা থাকে না।
উল্লেখ্য যে, বেহেশ্তের সকল দরজা খুলে দেওয়ার কারণ হল, যাতে করে আমলকারী তা শুনে আমলে আগ্রহ ও উৎসাহ পায় এবং তাতে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর দোযখের সকল দরজা বন্ধ করার কারণ হল,যাতে আমলকারী এই মাসে পাপে লিপ্ত না হয় এবং তাতে প্রবেশ না করে বসে। এর অর্থ এই নয় যে, যে ব্যক্তি রমাযান মাসে মারা যাবে সে বিনা হিসাবে সোজা বেহেশ্তে যাবে।(ফাসিঃ ২২পৃঃ)
৮। উচ্ছৃঙ্খল শয়তান দলকে এই মাসে বন্দী করে রাখা হয়।(বুখারী ১৮০, মুসলিম ১০৭৯নং) অর্থাৎ, তাদেরকে শিকল ওবেড়ি দিয়ে বেঁধে আটকে রাখা হয়। ফলে তারা রমাযানে সেই পাপাচরণ ঘটাতে সক্ষম হয় না,যতটা অন্য মাসে সক্ষম হয়। এ জন্য দেখা যায় যে,অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসে শয়তানের কুমন্ত্রণা, চক্রান্ত এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজ কম ঘটে থাকে। বরং শয়তান রমাযান মাসকে ভয় করে, যেমন ভয় করে আযান ও ইকামতকে এবং তার শব্দ শুনে পাদতে পাদতে পলায়ন করে।
কিন্তু আমরা এ মাসেও যে পাপাচরণও শয়তানী কর্মকাণ্ড ঘটতে দেখে থাকি তা উক্ত কথার বিরোধী নয়। কারণ, পাপ কেবল শয়তানই ঘটায় না। বরং মন্দপ্রবণ মানুষের মনও এমনিতেই পাপ করে থাকে। যে মন শয়তানের কুমন্ত্রণা সত্বর গ্রহণ করে থাকে এবং শয়তানের তাসীর কম বা বন্ধ হয়ে গেলেও সেই মন নিজেই পাপ সৃষ্টি করে। এটি হল মানুষের ‘নাফ্সে আম্মারাহ।’ যে নাফ্স বা মন শয়তানের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সেই পাপাচরণ ঘটিয়ে থাকে। নাঊযুবিল্লাহি মিন যালিক।(দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ২১পৃঃ)
৯। রমাযান মাসে আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়।(বুখারী ১৮৯৯, আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সিলসিলাহ সহীহাহ,আলবানী ১৮৬৮নং)
১০। এই মাসে দুআ কবুল হয়।মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, “(রমাযান মাসের) প্রত্যেক রাতে ও দিনে প্রত্যেক মুসলিমের দুআ কবুল করা হয়।”(বাযযার, সহীহ তারগীব, আলবানী ৯৮৮নং)
১১। এই মাসে রয়েছে এমন একটি রাত্রি, যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এই রাতের মঙ্গল থেকে বঞ্চিত হয়, সে আসলে সকল মঙ্গল থেকে বঞ্চিত। আর একান্ত বঞ্চিত ব্যক্তি ছাড়া সে মঙ্গল থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না।(সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ১৩৩৩, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৫১৯নং)
১২। এই মাসের প্রত্যেক রাত্রে একজন আহবানকারী (ফিরিশ্তা) আহবান করে বলেন, ‘ওহে কল্যাণকামী! তুমি অগ্রসর হও। আর ওহে মন্দকামী! তুমি ক্ষান্ত হও।’
১৩। এই মাসের প্রত্যেক রাত্রে মহান আল্লাহ দোযখ থেকে মুসলিম মুক্ত করে থাকেন।(আহমাদ, মুসনাদ ৪/৩১২, ৫/৪১১, নাসাঈ, সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ১৩৩১নং)
১৪। রমাযান মাস হল সবর ও ধৈর্যের মাস। যেহেতু রোযা ছাড়া অন্য ইবাদতে সেইরূপ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় না।মুসলিম এই মাসে পূর্ণ ৩০ বা ২৯টি দিনই পানাহার, স্ত্রী-মিলন এবং অন্যান্য রোযাবিরোধী সকল কর্ম থেকে ধৈর্যের সাথে বিরত থাকে। তাই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এই মাসকে ‘ধৈর্যের মাস’ বলে অভিহিত করেছেন।(সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৮০৩নং) আর তিনি বলেছেন, “ধৈর্যের (রমাযান) মাসে রোযা আর প্রত্যেক মাসের তিনটি রোযা অন্তরের বিদ্বেষ ও খট্কা দূর করে দেয়।”(বায্যার, ত্বাবারানী, মু’জাম, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহীহুল জামেইস সাগীর,আলবানী ৩৮০৪নং)
১৫। রমাযান হল কুরআনের মাস। কুরআন পঠন-পাঠন ও তেলাঅতের মাস। প্রশংসার অধিকারী বিজ্ঞানময় আল্লাহর তরফ থেকে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাস। এই মাসে কুরআন ‘লাওহে মাহফূয’ থেকে দুনিয়ার আসমানের প্রতি অবতীর্ণ হয়, অথবা কুরআন অবতীর্ণ হতে শুরু হয় এই পবিত্র মাসে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِالْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْشَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ﴾
“রমাযান মাস; যে মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এমাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে।”
(কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
আর কেবল কুরআনই নয়;বরং অন্যান্য আসমানী গ্রন্থসমূহও অবতীর্ণ হয়েছে এই বর্কতময় মাসেই। “ইবরাহীমের সহীফা সমূহ অবতীর্ণ হয়েছে রমাযান মাসের প্রথম রাতে, তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের সপ্তম রাতে, ইঞ্জীল অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের ১৪তম রাতে, যাবূর অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের ১৯শের রাতে এবং কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের ২৫শের রাতে।”(আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী,মু’জাম, সহীহুল জামেইস সাগীর,আলবানী ১৪৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৫৭৫নং)
১৬। রমাযান মাসে বিস্ময়কর বড় বড় বিজয় দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ইসলামকে সাহায্য করেছেন, মুসলিমদেরকে মর্যাদা দিয়েছেন। এই মাসেই বদর যুদ্ধে বদর প্রান্তরে মুসলিমদের আধ্যাত্মিক শক্তিমত্তা, ঈমানী ভিত্তির সুদৃঢ়তা এবং প্রতীতির অবিচলতা প্রকাশ পায়।আল্লাহ তাআলা এই দিনে তাঁদেরকে সাহায্য করেন এবং শত্রুর উপর বিজয়ী করেন।
অষ্টম হিজরীর রমাযান মাসে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁদেরকে সাহায্য করেন। যার পর মুসলিমরা স্থিতিশীলতা পেলেন এবং ইসলাম পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করল।(সাওমু রামাযান ৮-১৩পৃঃ)
১৭। রমাযান মাসে কোন কোন আমলের বহুগুণ সওয়াব লাভ হয়। এ মাসে উমরাহ আদায় আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়াসাল্লাম)-এর সাথে হজ্জ করার সমান।(বুখারী ১৮৬৩, মুসলিম ১২৫৬, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, সুনান)
পক্ষান্তরে এ মাসের রোযা রাখার সওয়াব প্রসঙ্গে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন,
(ক) “যে ব্যক্তি ঈমান ও বিশ্বাসের সাথে এবং সওয়াবের আশা রেখে রমাযানের রোযা রাখবে তারও পূর্বেকার পাপরাশি মাফ হয়ে যাবে।”(বুখারী ৩৮, ১৯০৮, মুসলিম ৭৬০, আবূ দাঊদ,নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)
(খ) “পাঁচ ওয়াক্ত নামায,এক জুমআহ হতে অপর জুমআহ পর্যন্ত ও এক রমাযান অপর রমাযান পর্যন্ত উভয়ের মধ্যবর্তীকালের সংঘটিত পাপরাশিকে মোচন করে দেয়; যদি কাবীরা গোনাহ থেকে দূরে থাকা হয় তবে।”(আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৫৯,৪০০, ৪১৪, মুসলিম ২৩৩নং)
(গ) এক ব্যক্তি মহানবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে হাজির হয়ে আরজ করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনার অভিমত কি? যদি আমি সাক্ষ্য দিই যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রসূল,পাঁচ-ওয়াক্ত নামায পড়ি, যাকাত আদায় করি এবং রমাযানের রোযা পালন করি, তাহলে আমি কাদের দলভুক্ত হব?’ উত্তরে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন,“তুমি সিদ্দীক ও শহীদগণের দলভুক্ত হবে।”(বায্যার, ইবনে খুযাইমাহ,সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহীহ তারগীব, আলবানী ৯৮৯নং)

No comments:

Post a Comment