Monday, June 8, 2015

শয়তান।




শয়তান।
-----------------
আমার মনের ভিতরে প্রায়ই অদম্য একটা
ইচ্ছে জাগে – ইশ্ শয়তানকে যদি
কোনভাবে নাই করে দেয়া যেত! রাগের
মাথায় কাউকে বলে ফেলা একটা কটু
কথা, পথ চলতে খুব ‘হট’ একটা মেয়েকে
আড়চোখে দেখা, নামাজ পড়ার সময়
পঞ্চসালা পরিকল্পনা করা, আলসেমি আর
কর্তব্যে অবহেলা ইত্যাদি আমার সব
দোষের পিছনেই আমি শয়তানের হাত
দেখতে পাই। তো এহেন আমি যে
শয়তানের মুন্ডুপাত করবো সেটাই
স্বাভাবিক। কিন্তু শয়তান আছে ও থাকবে
এবং যেহেতু সে আমাদের প্রকাশ্য শত্রু
তাই তার সম্পর্কে জেনে রাখাটা
আমাদের খুব জরুরি দরকার।
ইবলিস কেন শয়তানঃ
জিন্দের মানুষ সৃষ্টির বহুপুর্বেই সৃষ্টি করা
হয়েছিল এবং ইবলিস ছিল একজন জিন্।
সে ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য
লাভ করেছিল। কিন্তু যখন আল্লাহ স্বয়ং
আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করেন এবং আদমের
ক্ষমতা ও মর্যাদা দেখিয়ে সকলকে
আদেশ করেন আদমকে সম্মানুসূচক সিজদা
করতে, তখন ইবলিস অস্বীকৃতি জানায়।
আল্লাহ এর কারণ জানতে চাইলে সে বলে
যে আদম মাটির তৈরি আর সে আগুনের,
তাই সে আদমকে সিজদা করতে পারেনা।
আল্লাহ তার অবাধ্যতার জন্য তাকে
জান্নাত থেকে বহিষ্কার করে দিলে সে
বিচার দিবস পর্যন্ত অবকাশ চেয়ে নেয়
যেন সে আদম ও তার সন্তানদের বিভ্রান্ত
করতে পারে।
এখানে ইবলিস যে অন্যায়গুলো করেছিল
তা ব্যাখ্যা করতে গেলে আমরা দেখবো
আজ আমাদের মধ্যেও সে দোষগুলো
বিদ্যমান –
১. সে আল্লাহর সিজদা করবার নির্দেশের
অবাধ্য হয়েছিল, মুসলিম নামধারী
অনেকেই দৈনিক ১৭ রাকাত ফরজ
নামাজের ৩৪ টি ফরজ সিজদার নির্দেশ
উপেক্ষা করে।
২. সে অহংকার করে নিজেকে আদমের
চেয়ে উঁচুশ্রেণীর ভেবেছিল, অনেক
ভালো মুসলিমও অহংকার করে অন্য
মানুষদের কোন না কোন ভাবে খাটো করে
দেখে।
৩. সে অপরাধ করা সত্ত্বেও তা স্বীকার
করেনি ও ক্ষমা চায়নি, আমরাও প্রতিদিন
কত্ত অপরাধ করি – কিন্তু না সেটা
স্বীকার করি না ক্ষমা চাই।
৪. ইবলিস আল্লাহর সাথে উদ্ধত ব্যবহার
করেছিল, আমরা আজ মুসলিম হয়েও বিনয়
শব্দটাই ভুলতে বসেছি।
৫. সে আদমকে হিংসা করে নিজের ধ্বংস
ডেকে এনেছিল, কত মানুষ অন্যকারো
সাফল্যে হিংসার আগুনে জ্বলে নিজে
কষ্ট পায়।
৬. সে আল্লাহর সৃষ্টির ক্ষতি ও অকল্যাণ
কামনা করেছিল, আমরা প্রতিমুহুর্ত কত
মানুষের ক্ষতি চাইতে থাকি এবং সুযোগ
পেলে ক্ষতি করতে দ্বিধাও করিনা।
৭. সে আল্লাহর নির্দেশের বিপক্ষে
যুক্তি (Reasoning) দেখিয়েছিল। আজও
“মনের পর্দা বড় পর্দা” এ ধরণের যুক্তি
দেখিয়ে আল্লাহর পর্দার আদেশ লঙ্ঘন
করা হয়।
শয়তানের শয়তানীঃ
ইবলিস যখন আল্লাহর অভিশাপ পেয়ে
বিতাড়িত হল তখন থেকে তার উদ্দেশ্য
একটাই – যে আদমকে সে তুচ্ছজ্ঞান করে
সে আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে সেই
আদম ও তার সন্তানদের সে আল্লাহর
আদেশ অমান্য করাবে। আর এভাবেই সে
নিজের সাথে সাথে আল্লাহর শাস্তির
আওতায় সব মানুষকেই নিয়ে আসবে। সে
বলেছিল –
“হে আমার প্রভু, যেহেতু তুমি আমাকে
পথভ্রষ্ট করেছ, আমিও নিশ্চয়ই এ
পৃথিবীতে মানুষের কাছে সুশোভিত করে
দেখাব ভুলে ভরা পথকে এবং তাদের
সবাইকে পথভ্রষ্ট করবো। তবে তারা
ব্যতীত যাদের তুমি পথ দেখিয়েছ।” ৯
তবে আল্লাহ কিন্তু শয়তানকে পথভ্রষ্ট
করেননি, সে নিজে অহংকার করেছে,
অবাধ্য হয়েছে এবং আল্লাহর দয়া থেকে
নিরাশ হয়ে চির সর্বনাশের পথ বেছে
নিয়েছে।
তাই আল্লাহ আমাদের বললেন –
“নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
সে তো তার অনুসারীদের এই জন্য আহবান
করে যেন তারা জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী
হতে পারে।” ১০
আফ্রিকান একটা মেয়ের একটা
ফরওয়ার্ডেড মেইল পেয়েছিলাম
বছরখানেক আগে। এই মেয়েটি যখন প্রথম
জানতে পেরেছিলো সে তার বয়ফ্রেন্ডের
মাধ্যমে এইডস আক্রান্ত, সে তারপর প্রায়
হাজারখানেক পুরুষের শয্যাশায়ী
হয়েছিল। মৃত্যুর আগে সে মেইলে জানিয়ে
দেয় যে এই মরণজীবাণু সে ঐসব পুরুষদের
দেহেও ছড়িয়ে দিয়েছে। বস্তুত সে এটা
সহ্য করতে পারেনি যে- এই সুন্দর পৃথিবী
ছেড়ে সে চলে যাবে কিন্তু বাকি সবাই
বেঁচে থেকে তা উপভোগ করবে।
শয়তানের ব্যাপারটিও তাই। সে
জান্নাতে ছিল, সে জানে জান্নাত
কেমন। সে এটাও জানে জাহান্নামের
শাস্তি কেমন। তাই কোন মানুষ
জান্নাতের সুখ-শান্তি ভোগ করবে আর সে
জাহান্নামের আগুনে পুড়বে এটা সে
কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনা। এজন্য
সে তার সমস্ত শক্তি ব্যয় করে মানুষকে
তার আগুনের সংগী বানাবার জন্য।
শয়তান আল্লাহর অনুমতিতে দেখতে পায়
মানুষ মনেমনে কি ভাবছে। মানুষের
অন্যায় কামনা-বাসনার খবর সে রাখে
এবং সে সেই কাজগুলোকে যুক্তি ও
লোভের মাধ্যমে তার জন্য লোভনীয় করে
তুলে। যেমন যে সিগারেট খায় তাকে যদি
বলা হয় যে এটা ইসলামি শরিয়তে হারাম
তবে সে যুক্তি দেখায় – এটা হারাম না
মাকরুহ। যে মিলাদ করছে তাকে যদি বলা
হয় যে মিলাদ করা বিদ্আত, সে বলে
“তাহলে এত মানুষ যে করে।” যে মানুষটা
না বুঝেই ইসলাম মানে তার যখন একটা
বিপদ আসে তখন শয়তান তাকে বুঝায় “দেখ
তুমি এত ধর্ম-কর্ম কর অথচ তোমার কত
বিপদ কিন্তু যারা করেনা তারা কত
ভালো আছে!”
অপরদিকে ভালো কাজগুলোতে সে
নিরুৎসাহিত করে। যেমন কেউ প্রতিজ্ঞা
করলো সে নিয়মিত নামায পড়বে, শয়তান
তার মনে সন্দেহ ঢুকায় – তোমার কাপড়
অপবিত্র, এ দিয়ে নামায হবেনা। কেউ
ভাবলো কিছু টাকা দান করবে, তার মনে
তখন শয়তান তালিকা টাঙ্গায় – কি কি
জিনিস কিনতে হবে, আগে কেনাকাটা
তারপর দান-খয়রাত। কেউ ভাবলো সে একটু
ক্বুরান পড়বে, শয়তান তাকে বলে হাতের
কাজ শেষ করে নাও তারপর পড়ো। হাতের
কাজ শেষ হতে হতে জীবন শেষ হয়ে যায়,
আল্লাহর বাণীগুলো শোনার সময় আর
হয়না।
রসুলুল্লাহ (সাঃ) একদিন বলছিলেন –
“এমন কোন মানুষ নেই যার সাথে একজন
ফেরেশতা এবং একজন শয়তান থাকেনা।”
সাহাবিরা প্রশ্ন করেছিলেন “আপনার
সাথেও আছে?” উত্তরে তিনি বলেন “হ্যা,
আমার সাথেও আছে কিন্তু আল্লাহ
আমাকে তার ব্যাপারে সাহায্য করেছে
এবং তাই সে মুসলিম হয়ে গিয়েছে। এখন
সে আমাকে শুধু সৎ কাজের কথাই বলে।”
আমাদের সবার সাথেই শয়তান এবং
ফেরেশতা থাকে। এইজন্য খুব খারাপ
একটা মানুষও মাঝে মাঝে ভালো কাজ
করে, তার মাঝেমধ্যে ভালো হয়ে যেতে
ইচ্ছে করে। কিন্তু সে শয়তানের ধোঁকায়
পৃথিবীর মোহে সঠিক পথটা বেছে নিতে
পারেনা। আর একজন ভালো মানুষ সবসময়
চেষ্টা করে শয়তানের প্ররোচনা উপেক্ষা
করতে। কিন্তু কোন এক অসতর্ক মুহুর্তে
হয়তো সে পা হড়কায়, শয়তানের কাছে
হেরে যায়, একটা অন্যায় করে ফেলে।
কিন্তু পরমুহুর্তেই সে পরিতাপ করে, ক্ষমা
চায়। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় – যে
যত ভালো মানুষ তার পিছনে তত বেশি
শক্তিশালী শয়তান লেগে থাকে। তাই
একটা ভালো মানুষ যদি কোন খারাপ
কাজ করেই ফেলে তাহলে যেন আমরা
তার ঐ দোষটার জন্য বাকি সব ভাল গুণকে
অবজ্ঞা না করি।
কেন সৃজিলা বিধি শয়তানেঃ
আল্লাহ তো ভাল, তবে তিনি কেন
শয়তানের মত খারাপ একটা বস্তু সৃষ্টি
করলেন? আসলে আল্লাহ কোন খারাপ
জিনিস সৃষ্টি করেননি। তিনি মানুষের মত
শয়তানকেও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি
দিয়েছেন। মানুষ যেমন তার স্বাধীন ইচ্ছা
শক্তির অপব্যবহার করে অন্যায় পথ বেছে
নেয় শয়তানও তাই করেছিল। বস্তুত
আল্লাহর পরীক্ষা এখানেই যে তিনি
কাউকে কোন কিছু করতে বাধ্য করেননা।
তিনি সত্য ও অসত্য দু’টো পথই দেখিয়ে
দিয়েছেন, যে যেটা বেছে নেবে সে সেই
অনুসারে শাস্তি বা পুরষ্কার পাবে। সত্য
পথ দেখানোর জন্য তিনি যেমন দূত
পাঠিয়েছেন, তেমনি মিথ্যার উস্কানি
দিতে শয়তানকে কিয়ামাত পর্যন্ত
অবকাশ দিয়েছেন। আর সত্য-মিথ্যার
পার্থক্য করতে তিনি মানুষকে বিবেক-
বুদ্ধি দিয়েছেন।
আমরা জাগতিক বিচারেও দেখি যে
পরীক্ষা যত কঠিন তাতে উত্তীর্ণ হলে
তার ফলাফল তত দামী। এজন্য উন্মুক্ত
বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা বোর্ডের
এসএসসি-র মান এক নয়। জান্নাত আল্লাহর
এক অসীম অনুগ্রহ, অচিন্তনীয় পুরষ্কার।
এটা পেতে আমাদের যোগ্যতা দেখাতে
হবে। যদিও আল্লাহর দয়া ছাড়া শুধু
আমাদের কাজ দিয়ে এত বড় পুরষ্কার
পাবার যোগ্য আমরা কেউই না তবুও তা
পাবার জন্য পরিশ্রম করতে হবে, সাধনা
করতে হবে, নিজের আত্মাকে দমন করতে
হবে, শয়তানের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।
শয়তান যদি নাই থাকত তবে এই পরীক্ষাও
থাকতনা, পুরষ্কারও থাকত না।
শেষ কথাঃ
শয়তানকে দুর্দমনীয় ভাবার আসলে কোন
কারণ নেই। কারণ তার ক্ষমতা সীমিত আর
আল্লাহর অনুগ্রহ অসীম। আর আল্লাহ
আমাদের এভাবে আশ্বস্ত করেছেন –
“নিশ্চয়ই তার (শয়তানের) কোন ক্ষমতা
নেই তাদের উপরে যারা বিশ্বাসী এবং
যারা শুধুমাত্র তাদের প্রতিপালকের উপর
নির্ভর করে। তার ক্ষমতা তো শুধু তাদের
উপর যারা তাকে মানে ও অনুসরণ করে
এবং আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন
করে”১১
আঊ’যু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির
রাজীম।
অভিশপ্ত বিতাড়িত শয়তান হতে আল্লাহর
কাছে রক্ষা চাচ্ছি।
…………………………………………………………
১. Corinthians 4:4
২. আল-হিজর, ১৫-২৭
৩. সহিহ মুসলিম
৪. আল-কাহাফ, ১৮-৫০
৫. আল-আরাফ, ৭-২৭
৬. আল-যারিয়াত, ৫১-৫৬
৭. আল-জিন্, ৭২-১১
৮. সহিহ বুখারি, ৩২৮১
৯. আল-হিজর, ১৫-৩৯,৪০
১০. আল-ফাতির, ৩৫-৬
১১. আল-নাহল, ১৬- ৯৮-১০০

No comments:

Post a Comment