Sunday, July 12, 2015

লাইলাতুল কদরের ফযিলতঃ




লাইলাতুল কদরের ফযিলতঃ
======================
মহান আল্লাহ বলেন:
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ ٣ فِيهَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ ٤﴾[القدر: 3-4]
-নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।[১]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥﴾ [القدر: 1-5]
- আমি একে নাযিল করেছি লাইলাতুল-কদরে। লাইলাতুল-কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন? লাইলাতুল-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত। [২]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
«مَنْ يَقُمْ لَيْلَةَ القَدْرِ إيمَاناً واحتِسَاباً غُفِرَ لهُ مَا تَقدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ» رَوَاهُ الشَيْخَان.
-লাইলাতুল কদরে যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে কিয়াম করবে, তার পূর্বের সকল পাপ মোচন করা হবে। [৩]
হাদিসটি অন্য শব্দে এভাবে বর্ণিত আছে:
«مَنْ قَامَ لَيْلةَ القَدرِ إيماناً واحتِسَاباً غُفِرَ له مَا تَقَدَّمَ من ذَنبِهِ»
-লাইলাতুল কদরে যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় কিয়াম করবে, তার পূর্বের সকল পাপ মোচন করা হবে।[৪]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেছেন:
«إنَّهَا لَيْلَةُ سَابعةٍ أو تَاسِعَةٍ وعِشْرِينَ إِنَّ الملائِكَةَ تِلْكَ اللَّيلةَ في الأرْضِ أَكْثَرُ مِنْ عَدَدِ الحَصَى» رَواهُ أَحْمَد.
-লাইলাতুল কদর সাতাশ অথবা ঊনত্রিশের রাত, সে রাতে পৃথিবীতে ফেরেশতাদের সংখ্যা কঙ্করের চেয়ে অধিক হয়। [৫]
■শিক্ষা ও মাসায়েলঃ
===================
❏ লাইলাতুল কদরের ফযিলতের কয়েকটি দিকঃ
✏ এ রাত আল্লাহর নিকট খুব মর্যাদাপূর্ণ।
✏ এ রাত এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, যেখানে লাইলাতুল কদর নেই; যা প্রায় তিরাশি বছর চার মাসের সমপরিমাণ।
✏ এ রাতে অগণিত ফেরেশতাদের অবতরণ হয়, যাদের সংখ্যা কঙ্করের চেয়ে বেশী।
✏ এ রাতে কুরআনুল কারিম নাযিল করা হয়েছে।
✏ এ রাতে অধিক পরিমাণ আযাব থেকে নিরাপত্তা নাযিল হয়, কারণ এতে বান্দাগণ অধিক পরিমাণ ইবাদত করে, যার ফলে আল্লাহ তাদেরকে রহমত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদ দান করেন।
✏ এ রাত বরকতময়, কারণ এ রাতের ফযিলত অনেক।
✏ এ রাতে যে বিশ্বাস, আল্লাহর ওয়াদার ওপর আস্থা ও সওয়াবের আশায় কিয়াম করবে, তার পূর্বের পাপ মোচন করা হবে।
✏ এ রাতে পূর্ণ বছরের তাকদির লেখা হয়।
✏ এ রাতে যে কিয়াম করল ও জাগ্রত থাকল, সে অবশ্যই আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের উপযুক্ত হল।
❏ মুসলিমদের উচিত লাইলাতুল কদর তালাশ করা। এ জন্য শেষ দশকে কিয়াম, সালাত, দো‘আ ও যিকরে অধিক মশগুল থাকা। মাহরুম ও বঞ্চিত ব্যতীত কেউ ফযিলতপূর্ণ এ রাত থেকে গাফেল থাকে না। আল্লাহর নিকট দো‘আ করছি, তিনি আমাদেরকে এ ফযিলত অর্জনের তওফিক দান করুন।
❏ লাইলাতুল কদরের বরকতের অর্থ তাতে সম্পাদিত আমলের বরকত, কারণ এ রাতে যে যত্নসহ আমল করবে, তার আমল হাজার মাসের আমলের চেয়ে উত্তম। এটা আল্লাহর মহান অনুগ্রহ।
❏ এ উম্মতের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে প্রতি বছর এ রাত দান করেন।
❏ লাইলাতুল কদর অন্য সকল রাত থেকে উত্তম, জুমার রাত লাইলাতুল কদর থেকে উত্তম এ কথা শুদ্ধ নয়। হ্যাঁ যদি জুমার রাতে লাইলাতুল কদর হয়, তাহলে তার ফযিলত বৃদ্ধি হয় সন্দেহ নেই।
❏ নবী ﷺ এর ক্ষেত্রে ইসরা ও মেরাজের রাত লাইলাতুল কদর থেকে উত্তম। কারণ এ রাতে তাকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এ রাতে তার সাথে তার রব কথা বলেছেন। এটা তার জন্য সবচেয়ে বড় সম্মান ও মহান মর্যাদা। তবে অন্যান্য মুসলিমের বিবেচনায় ইসরা ও মেরাজের রাতের তুলনায় লাইলাতুল কদর মহান ও অধিক মর্যাদাশীল।[৬]
❏ কতক আলেম উল্লেখ করেছেন লাইলাতুল কদর এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য, কতক দুর্বল হাদিসে এ রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। এর বিপরীতে কতক হাদিসে এসেছে আমাদের পূর্বের উম্মত বা তাদের নবীদের মধ্যেও লাইলাতুল কদর ছিল, তবে এসব হাদিস দুর্বল। [৭]
❏ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে:
«مَنْ يَقُمْ لَيْلَةَ القَدْرِ فَيُوَافقُها إيمَاناً واحتِسَاباً غُفِرَ لهُ»
-যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর জেনে ঈমান ও সওয়াবের আশায় কিয়াম করবে, তার পাপ মোচন করা হবে। এ হাদিস তাদের দলিল, যারা বলে: লাইলাতুল কদর তার জন্যই হবে, যে জানে যে আজ লাইলাতুল কদর। কিন্তু হাদিসের বাহ্যিক শব্দ তা প্রমাণ করে না, বরং হাদিসের অর্থ হচ্ছে, যে লাইলাতুল কদরে কিয়াম করে লাইলাতুল কদরে কিয়াম করার নিয়তে, আর বাস্তবিক তা লাইলাতুল কদর হয় কিন্তু সে তা নিশ্চিত জানে না সে লাইলাতুল কদর লাভ করবে। [৮]
অতএব মুসলিমদের উচিত রমযানের শেষ দশকের প্রত্যেক রাতকে লাইলাতুল কদর জ্ঞান করে কিয়াম করা, কারণ সে রাত লাইলাতুল কদর হতে পারে, আর বাস্তবিক পক্ষে যদি সে রাত লাইলাতুল কদর হয়, তাহলে সে জেনে তাতে কিয়াম করল।
সোর্সঃ________________
১। সূরা দুখান: (৩-৪)
২। সূরা আল-কাদর: (১-৫)
৩। বুখারি: (৩৫), মুসলিম: (৭৬০)
৪। বুখারি: (১৮০২), মুসলিম: (৭৬০)
৫। আহমদ: (২/৫১৯), তায়ালিসি: (২৫৪৫), ইব্‌ন খুযাইমাহ হাদিসটি সহিহ বলেছেন: (২১৯৪)
৬। মাজমু ফাতাওয়া ইব্‌ন তাইমিয়াহ: (২৫/২৮৬)
৭। আমাদের পূর্বে লাইলাতুল কদর ছিল যেসব হাদিসে এসেছে, তার মধ্যে আবু যর (রাঃ) এর হাদিস অন্যতম, তাতে এসেছে:
«قلت: تكون مع الأنبياء ما كانوا فإذا قبضوا رفعت أم هي إلى يوم القيامة؟ قال: بل إلى يوم القيامة»
-আমি বললাম: লাইলাতুল কদর কি নবীদের যুগ পর্যন্ত থাকে, অতঃপর তা উঠিয়ে নেয়া হয়, না কিয়ামত পর্যন্ত থাকে? তিনি বললেন: বরং কিয়ামত পর্যন্ত থাকে। [ আহমদ: (৫/১৭১), নাসায়ি ফিল কুবরা: (৩৪২৭), হাকেম: (১/৩০৭), তিনি মুসলিমের শর্ত মোতাবেক হাকিম হাদিসটি সহিহ বলেছেন, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন। কিন্তু আলবানি ইব্‌ন খুজাইমার টিকায় তা দুর্বল বলেছেন: (২১৭০), তিনি উল্লেখ করেছেন এর সনদে মুরসিদ যামানি রয়েছে, সে মাজহুল। উকাইলি বলেছেন: তার হাদিসের কোন ‘মুতাবে’ পাওয়া যায় না]
আর যেসব হাদিসে এসেছে যে, লাইলাতুল কদর এ উম্মতের সাথে খাস, যেমন ইমাম মালেক বর্ণনা করেছেন:
«أن النبي ﷺ أُريَ أعمار الناس قبله أو ما شاء الله من ذلك فكأنه تقاصر أعمار أمته ألا يبلغوا من العمل مثل الذي بلغ غيرهم في طول العمر فأعطاه الله ليلة القدر خيراً من ألف شهر»
-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার পূর্বের লোকের বয়স দেখানো হয়েছে, অথবা আল্লাহ যা ইচ্ছা তাকে দেখিয়েছেন, অতঃপর তিনি নিজের উম্মতের বয়স তুচ্ছ জ্ঞান করেন যে, তারা তাদের পূর্বের উম্মতের আমলের বরাবর হতে পারবে না, ফলে আল্লাহ তাকে লাইলাতুল কদর দান করেন, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম”। মালেক ফিল মুয়াত্তা: (১/৩২১), হাফেয ইব্‌ন আব্দুর বারর বলেছেন: “আমি জানি না, এ হাদিস কেউ মুসনাদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন কি-না, আমাদের জানা মতে মুয়াত্তা ব্যতীত কেউ এ হাদিস মুরসাল বা মুসানদে বর্ণনা করেন নি”। তামহিদ: (২৪/৩৭৩)
আনাস থেকে বর্ণিত হাদিস:
«إن الله عز وجل وهب لأمتي ليلة القدر ولم يعطها من كان قبلكم»
-নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতকে লাইলাতুল কদর দান করেছেন, যা পূর্বের কোন উম্মতকে দান করা হয়নি। [ দায়লামি: (৬৪৭), দায়িফুল জামে: (১৬৬৯) গ্রন্থে রয়েছে এ হাদিসটি মওজু ও বানোয়াট। ইমাম নববী লাইলাতুল কদরের বৈশিষ্ট গণনায় বলেন: “লাইলাতুল কদর এ উম্মতের সাথে খাস, আল্লাহ এ রাতের সম্মান বৃদ্ধি করুন, এ উম্মতের পূর্বে কোন উম্মতে লাইলাতুল ছিল না... এটা বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ, আমাদের সাথী ও জমহুর আলেমদের এটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত”। মাজমু: (৬/৪৫৭-৪৫৮)
৮। দেখুন: তারহুত তাসরিব: (৪/১৬৪), যখিরাতুল উকবা: (২১/৫১-৫২)
উল্লেখ্য: আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: “যে ব্যক্তি এশার সালাত জামাতে পড়ল সে লাইলাতুল কদর লাভ করল”। ইব্‌ন খুযাইমাহ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, আলবানি তার টিকায় তা দুর্বল বলেছেন: (৩/৩৩৩), খতিবে বাগদাদি: (৫/৩৩২) এ হাদিসটি আনাস থেকে বর্ণনা করেছেন, যা বানোয়াট। দেখুন: যাওয়ায়েদে তারিখে বাগদাদ আলাল কুতুবিস সিত্তাহ লিশ শায়খ খালদুন আল-আহদাব: (৪/৫৯৪), হাদিস নং: (৭৯২), মুয়াত্তায় সায়িদ ইব্‌ন মুসাইয়্যেব এর মুরসাল হাদিস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে: (১/৩২১)

No comments:

Post a Comment