বিয়ের সময় স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করতে হবে, এটা স্বামী কর্তৃক প্রদেয় স্ত্রীর জন্য আইনগত অধিকার। মুসলিম আইনে দেনমোহর স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও নারীর অর্থনৈতিক অধিকার সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে বিবাহ বন্ধনের সময় স্ত্রীর দেনমোহর আদায় করা পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক। দেনমোহর স্বামীর ঋণ, যা স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য।
_____________________
বিবাহ এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একে অন্যের কাছে উপকৃত ও পরিতৃপ্ত। কিন্তু স্বামীর অধিকার বেশী। তাই স্ত্রীর কর্তব্য অধিক। স্ত্রী তার দেহ-যৌবন সহ স্বামীর বাড়িতে এসে বা সদা ছায়ার ন্যায় স্বামী-পাশে থেকে তার অনুসরণ ও সেবা করে।
_____________________
তাই তো এই চুক্তিতে তাকে এমন কিছু পারিতোষিক প্রদান করতে হয় যাতে সে সন্তুষ্ট হয়ে স্বামীর বন্ধনে আসতে রাজী হয়ে যায়। সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং মানুষকে এ বিধান দিয়েছেন। তিনি বলেন,
_____________________
﴿ ﻭَﺍﻟْﻤُﺤْﺼَﻨَﺎﺕُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀِ ﺇِﻻَّ ﻣَﺎ ﻣَﻠَﻜَﺖْ ﺃَﻳْﻤَﺎﻧُﻜُﻢْ ﻛِﺘَﺎﺏَ ﺍﻟﻠﻪِ
ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻭَﺃُﺣِﻞَّ ﻟَﻜُﻢْ ﻣَﺎ ﻭَﺭَﺍﺀَ ﺫَﻟِﻜُﻢْ ﺃَﻥْ ﺗَﺒْﺘَﻐُﻮﺍ ﺑِﺄَﻣْﻮَﺍﻟِﻜُﻢْ
ﻣُﺤْﺼِﻨِﻴﻦَ ﻏَﻴْﺮَ ﻣُﺴَﺎﻓِﺤِﻴﻦَ ﻓَﻤَﺎ ﺍﺳْﺘَﻤْﺘَﻌْﺘُﻢْ ﺑِﻪِ ﻣِﻨْﻬُﻦَّ
ﻓَﺂﺗُﻮﻫُﻦَّ ﺃُﺟُﻮﺭَﻫُﻦَّ ﻓَﺮِﻳﻀَﺔً ﴾
_____________________
‘‘উল্লেখিত (অবৈধ) নারীগণ ব্যতীত অন্যান্য নারীগণকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তোমাদের স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য, ব্যভিচারের জন্য নয়। তাদের মধ্যে যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহর অর্পণ করবে।’’ [1] (সূরা আন নিসা (৪) : ২৪)
_____________________
তিনি অন্যত্র বলেন,
﴿ ﻭَﺁﺗُﻮﺍ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀَ ﺻَﺪُﻗَﺎﺗِﻬِﻦَّ ﻧِﺤْﻠَﺔً ﴾
‘‘আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশীমনে।’’ [2] (সূরা সূরা আন নিসা (৪) : ৪)
_____________________
আর প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,
ﺇِﻥَّ ﺃَﺣَﻖَّ ﺍﻟﺸَّﺮْﻁِ ﺃَﻥْ ﻳُﻮﻓَﻰ ﺑِﻪِ ﻣَﺎ ﺍﺳْﺘَﺤْﻠَﻠْﺘُﻢْ ﺑِﻪِ ﺍﻟْﻔُﺮُﻭﺝَ .
‘‘সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যা পূরণ করা জরুরী, তা হল সেই বস্ত্ত যার দ্বারা তোমরা স্ত্রীদের হালাল করে থাক।’’ [3] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ১৫৪৭নং)
_____________________
সুতরাং স্ত্রীকে তার ঐ প্রদেয় মোহর প্রদান করা ফরয। জমি, জায়গা, অর্থ, অলঙ্কার, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি মোহরে দেওয়া চলে। বরং প্রয়োজনে (পাত্রীপক্ষ রাজী হলে) কুরআন শিক্ষাদান, ইসলাম গ্রহণও মোহর হতে পারে। [4] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২০২-৩২০৯নং)
_____________________
মোহর কম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে সেবচ্ছায় বেশী দেওয়া নিন্দনীয় নয়। মহানবী (সাঃ) তাঁর কোন স্ত্রী ও কন্যার মোহর ৪৮০ দিরহাম (১৪২৮ গ্রাম ওজনের রৌপ্যমুদ্রা) এর অধিক ছিল না। [5] (ইরওয়াউল গালীল ১৯২৭নং)
_____________________
হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর মোহর ছিল একটি লৌহবর্ম। [6] (সহীহ আবু দাউদ, আল্লামা আলবানী ১৮৬৫নং, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ১/৮০)
_____________________
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, তাঁর মোহর ছিল ৫০০ দিরহাম (১৪৮৭,৫ গ্রাম ওজনের রৌপ্য মুদ্রা)। [7] (সহীহ আবু দাউদ ১৮৫১নং)
_____________________
তবে কেবল উম্মে হাবীবার মোহর ছিল ৪০০০ দিরহাম (১১৯০০ গ্রাম রৌপ্য মুদ্রা)। অবশ্য এই মোহর বাদশাহ নাজাশী মহানবী (সাঃ) এর তরফ থেকে আদায় করেছিলেন। [8] (সহীহ আবু দাউদ ১৮৫৩)
_____________________
তাছাড়া তিনি বলেন, ‘‘নারীর বরকতের মধ্যে; তাকে পয়গাম দেওয়া সহজ হওয়া, তার মোহর স্বল্প হওয়া এবং তার গর্ভাশয়ে সহজে সন্তান ধরা অন্যতম।’’ [9] (সহীহুল জামে ২২৩৫নং)
_____________________
হযরত মূসা (আঃ) তাঁর প্রদেয় মোহরের বিনিময়ে শবশুরের আট অথবা দশ বছর মজুরী করেছিলেন। [10] (সূরা আল কাসাস (২৮) : ২৭)
_____________________
মোহর হাল্কা হলে বিবাহ সহজ-সাধ্য হবে; এবং সেটাই বাঞ্ছিত। পক্ষান্তরে পণপ্রথার মত মোহর অতিরিক্ত বেশী চাওয়ার প্রথাও একটি কুপ্রথা। মোহরের অর্থ কেবলমাত্র স্ত্রীর প্রাপ্য হক; অভিভাবকের নয়। এতে বিবাহের পরে স্বামীরও কোন অধিকার নেই। স্ত্রী বৈধভাবে যেখানে ইচ্ছা সেখানে খরচ করতে পারে। [11] (ফাতাওয়াল মারআহ ১০৫-১০৯পৃঃ)
_____________________
অবশ্য স্ত্রী সন্তুষ্টচিত্তে সেবচ্ছায় স্বামীকে দিলে তা উভয়ের জন্য বৈধ। [12] (সূরা আন-নিসা (৪) : ৪)
_____________________
স্ত্রীকে মোহর না দিয়ে বিবাহ করলে অনেকের নিকট বিবাহ বাতিল। [13] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৯)
_____________________
আকদের সময় মোহর নির্ধারিত না করলেও বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মিলনের পর স্ত্রী সেই মহিলার সমপরিমাণ চলতি মোহরের অধিকারিণী হবে, যে সর্বদিক দিয়ে তারই অনুরূপ। মিলনের পূর্বে স্বামী মারা গেলেও ঐরূপ চলতি মোহর ও মীরাসের হকদার হবে। [14] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৯-১৫০)
_____________________
মোহর নির্দিষ্ট না করে বিবাহ হয়ে মিলনের পূর্বেই স্বামী তালাক দিলে স্ত্রী মোহরের হকদার হয় না। তবে তাকে সাধ্যমত অর্থাদি খরচ-পত্র দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। [15] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৬)
_____________________
বিবাহের সময় মোহর নির্ধারিত করে সম্পূর্ণ অথবা কিছু মোহর বাকী রাখা চলে। মিলনের পর স্ত্রী সে ঋণ মওকুফ করে দিতে পারে। নচেৎ ঋণ হয়ে তা স্বামীর ঘাড়ে থেকেই যাবে। মোহর নির্ধারিত করে বা কিছু আদায়ের পর বিবাহ হয়ে মিলনের পূর্বে স্বামী মারা গেলেও স্ত্রী পূর্ণ মোহরের হকদার হবে। স্ত্রী মারা গেলে স্বামী মোহর ফেরৎ পাবে না। [16] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৮)
_____________________
মোহর নির্দিষ্ট করে আদায় করে দিয়ে মিলন করার পর স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে মোহর ফেরৎ পাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
_____________________
﴿ ﻭَﺇِﻥْ ﺃَﺭَﺩْﺗُﻢُ ﺍﺳْﺘِﺒْﺪَﺍﻝَ ﺯَﻭْﺝٍ ﻣَﻜَﺎﻥَ ﺯَﻭْﺝٍ ﻭَﺁﺗَﻴْﺘُﻢْ ﺇِﺣْﺪَﺍﻫُﻦَّ
ﻗِﻨْﻄَﺎﺭﺍً ﻓَﻼ ﺗَﺄْﺧُﺬُﻭﺍ ﻣِﻨْﻪُ ﺷَﻴْﺌﺎً ﺃَﺗَﺄْﺧُﺬُﻭﻧَﻪُ ﺑُﻬْﺘَﺎﻧﺎً ﻭَﺇِﺛْﻤﺎً
ﻣُﺒِﻴﻨﺎً- ﻭَﻛَﻴْﻒَ ﺗَﺄْﺧُﺬُﻭﻧَﻪُ ﻭَﻗَﺪْ ﺃَﻓْﻀَﻰ ﺑَﻌْﻀُﻜُﻢْ ﺇِﻟَﻰ ﺑَﻌْﺾٍ
ﻭَﺃَﺧَﺬْﻥَ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﻣِﻴﺜَﺎﻗﺎً ﻏَﻠِﻴﻈﺎً ﴾
_____________________
‘‘আর যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা স্থির কর এবং তাদের একজনকে প্রচুর অর্থও দিয়ে থাক, তবুও তা থেকে কিছুই গ্রহণ করো না। তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপাচারণ দ্বারা তা গ্রহণ করবে? কিভাবে তোমরা তা গ্রহণ করবে, অথচ তোমরা পরস্পর সহবাস করেছ এবং তারা তোমাদের কাছ থেকে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নিয়েছে?’’ [17] (সূরা আন-নিসা (৪) : ২০-২১)
_____________________
মোহর ধার্য হয়ে আদায় না করে মিলনের পূর্বেই তালাক দিলে নির্দিষ্ট মোহরের অর্ধেক আদায় করতে হবে। অবশ্য যদি স্ত্রী অথবা যার হাতে বিবাহবন্ধন সে ( স্বামী) মাফ করে দেয়, তবে সে কথা ভিন্ন। তবে মাফ করে দেওয়াটাই আত্মসংযমের নিকটতর। [18] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৭)
_____________________
মিলনের পূর্বে যদি স্ত্রী নিজের দোষে তালাক পায় অথবা খোলা তালাক নেয়, তবে মোহর তো পাবেই না এবং কোন খরচ-পত্রও না। [19] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৫১-১৫২)
_____________________
মোহর আদায় করে দিয়ে থাকলে মিলনের পরেও যদি স্ত্রী খোলা তালাক চায়, তাহলে স্বামীকে তার ঐ প্রদত্ত মোহর ফেরৎ দিতে হবে। [20] (বুখারী, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৭৪নং)
_____________________
কোন অবৈধ বা অগম্যা নারীর সাথে ভুলক্রমে বিবাহ হয়ে মিলনের পর তার অবৈধতা (যেমন গর্ভ সন্তান আছে বা দুধ বোন হয় ইত্যাদি) জানা গেলে ঐ স্ত্রী পূর্ণ মোহরের হকদার হবে। তবে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ওয়াজেব। [21] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৯)
_____________________
একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে সকল স্ত্রীর মোহর সমান হওয়া জরুরী নয়। [22] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৬/২৬২)
_____________________
স্ত্রীর মোহরের অর্থ খরচ করে ফেলে স্বামী যদি তার বিনিময়ে স্ত্রীকে তার সমপরিমাণ জমি বা জায়গা লিখে দেয় তবে তা বৈধ। [23] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২৫/৪৭)
_____________________
পক্ষান্তরে অন্যান্য ওয়ারেসীনরা রাজী না হলে কোন স্ত্রীর নামে (বা কোন ওয়ারেসের নামে) অতিরিক্ত কিছু জমি-জায়গা উইল করা বৈধ নয়। কারণ, কোন ওয়ারেসের জন্য অসিয়ত নেই। [24] (মিশকাতুল মাসাবীহ ৩০৪৭নং, ইরঃ ১৬৫৫নং)
_____________________
পাত্রীর নিকট থেকে ৫০ হাজার (পণ) নিয়ে ১০ বা ২০ হাজার তাকে মোহর দিলে অথবা নামে মাত্র মোহর বাঁধলে এবং আদায়ের নিয়ত না থাকলে অথবা দশ হাজার দশ টাকা আদায় ও অবশিষ্ট বাকী রেখে আদায়ের নিয়ত না রাখলে; অর্থাৎ স্ত্রীর ঐ প্রাপ্য হক পূর্ণমাত্রায় আদায় করে দেওয়ার ইচ্ছা না থাকলে এই ধোঁকায় বিবাহ হবে কি না সন্দেহ। অবশ্য এ কাজ যে আল্লাহর ফরয আইনের বিরুদ্ধাচরণ তাতে কোন সঃন্দেহ নেই।
_____________________
প্রকাশ থাকে যে, মোহর বিজোড় বাঁধা বা এতে কোন শুভলক্ষণ আছে মনে করা বিদআত।
_____________________
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
( من تَزوَّج بصدَاقٍ لا يَنْوِي أداءَهُ فهو زَانٍ , و من أدَانَ دَيْناً و هو لا يَنْوِي قَضَاءَهُ فهو سارقٌ (رواه أحمد و ابن ماجه
_____________________
যে ব্যক্তি এমন পরিমাণ মোহরের বিনিময়ে বিয়ে করেছে, যা সে পরিশোধ করার নিয়ত নেই, সে ব্যক্তি ব্যভিচারী। হাদসটি ইমাম আহমাদ ও ইবনু মাজাহ রহ. বর্ণনা করেছেন।
_____________________
আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন,
﴿ ﺍﺗَّﺒِﻌُﻮﺍ ﻣَﺎ ﺃُﻧْﺰِﻝَ ﺇِﻟَﻴْﻜُﻢْ ﻣِﻦْ ﺭَﺑِّﻜُﻢْ ﻭَﻻَ ﺗَﺘَّﺒِﻌُﻮﺍ ﻣِﻦْ ﺩُﻭﻧِﻪِ
ﺃَﻭْﻟِﻴَﺎﺀَ ﻗَﻠِﻴﻼً ﻣَﺎ ﺗَﺬَﻛَّﺮُﻭﻥَ ﴾
_____________________
(হে মানুষ!) ‘‘তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাঁকে ছাড়া ভিন্ন অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক। [25] (সূরা আল-আ‘রাফ (৭) : ৩
No comments:
Post a Comment