Tuesday, February 17, 2015

মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের নিদর্শন



‎মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের নিদর্শন

এক. কাফের দেশ ছেড়ে মুসলিম দেশে হিজরত করা:
হিজরত হল, দ্বীনকে রক্ষার তাগিদে কাফের দেশ থেকে মুসলিম দেশে চলে আসা।
এখানে হিজরতের যে অর্থ ও উদ্দেশ্য আলোচনা করা হয়েছে, সে অর্থ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে হিজরত করা প্রতিটি মুসলিমের উপর ওয়াজিব এবং এ অর্থ ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী হিজরত করার বিধান কিয়ামত পর্যন্ত বাকী থাকবে। যারা হিজরত করতে সক্ষম তারপরও মুশরিকদের মাঝে অবস্থান করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে নিজেকে দায়িত্বমুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন। তবে যদি এমন হয় যে হিজরত করতে সক্ষম নয়, বা সেখানে অবস্থানের পিছনে কোন দীনি উদ্দেশ্য থাকে যেমন- আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া, ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য কাজ করা ইত্যাদি তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ تَوَفَّىٰهُمُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ ظَالِمِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَالُواْ فِيمَ كُنتُمۡۖ قَالُواْ كُنَّا مُسۡتَضۡعَفِينَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ قَالُوٓاْ أَلَمۡ تَكُنۡ أَرۡضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةٗ فَتُهَاجِرُواْ فِيهَاۚ فَأُوْلَٰٓئِكَ مَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ٩٧ إِلَّا ٱلۡمُسۡتَضۡعَفِينَ مِنَ ٱلرِّجَالِ وَٱلنِّسَآءِ وَٱلۡوِلۡدَٰنِ لَا يَسۡتَطِيعُونَ حِيلَةٗ وَلَا يَهۡتَدُونَ سَبِيلٗا ٩٨ فَأُوْلَٰٓئِكَ عَسَى ٱللَّهُ أَن يَعۡفُوَ عَنۡهُمۡۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَفُوًّا غَفُورٗا ٩٩﴾ ] سورة النساء:97-98].
“নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কি অবস্থায় ছিলে’? তারা বলে, ‘আমরা জমিনে দুর্বল ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে’? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তন স্থল। তবে যে দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন রাস্তা খুঁজে পায় না। অতঃপর আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ মার্জনা-কারী, ক্ষমাশীল”[20]। [সূরা নিসা, আয়াত: ৯৭, ৯৮]

দুই. মুসলিমদের সাহায্য করা এবং জান, মাল ও জবান দ্বারা তাদের দীনি ও দুনিয়াবি বিষয়ে সহযোগিতা করা[21]:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
  ﴿وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖ﴾ [سورة التوبة: 71]
“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু”। [সূরা তাওবা, আয়াত: ৭১]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
 ﴿وَإِنِ ٱسۡتَنصَرُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ فَعَلَيۡكُمُ ٱلنَّصۡرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوۡمِۢ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَٰقٞۗ﴾ [سورة الأنفال :72]
“আর যদি তারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের নিকট কোন সহযোগিতা চায়, তাহলে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে এমন কওমের বিরুদ্ধে নয়, যাদের সাথে তোমাদের একে অপরের চুক্তি রয়েছে”। [সূরা আনফাল, আয়াত: ৭২]

তিন. ঈমানদার ব্যথায় ব্যথিত হওয়া এবং তাদের সুখে খুশি হওয়া[22]:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 «مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بالْحُمَّى والسَّهَرِ »
“মুমিনদের দৃষ্টান্ত পরস্পর মহব্বত, দয়া ও সহানুভূতির দিক দিক দিয়ে, একই দেহের মত, তার দেহের একটি অঙ্গ যদি আক্রান্ত হয়, তখন তার সারা শরীর আক্রান্ত হয়। সে সারা শরীরে জ্বর অনুভব করে এবং অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়”[23]।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
« الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضاً وَشَبَّكَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ »
“মুমিনরা মুমিনের জন্য একটি দেয়ালের মত; তার এক অংশ অপর অংশকে শক্তি জোগান দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা কলে উভয় হাতের আঙ্গুলগুলোকে একত্র করে দেখান”।

চার. ঈমানদারদের হিতাকাঙ্খি হওয়া, তাদের কল্যাণকামী হওয়া, তাদের সাথে কোন প্রকার প্রতারণা না করা এবং তাদের কোন প্রকার ধোঁকা না দেওয়া:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
  « لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ».
“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমার নিজের জন্য যা পছন্দ কর তা তোমার ভাইয়ের জন্যও পছন্দ কর”[24]। [বুখারি কিতাবুল মাযালিম: পরিচ্ছেদ: মজলুমকে সাহায্য করা বিষয়ে আলোচনা।]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
« الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَحْقِرُهُ وَلَا يَخْذُلُهُ ولايُسْلِمُهُ ، بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنْ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ ، كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ »
“একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই স্বরূপ। মুসলিম হিসেবে সে তার অপর ভাইকে অপমান করতে পারে না, তিরস্কার করতে পারে না এবং তাকে দুশমনের হাতে সোপর্দ করতে পারে না। একজন মানুষ খারাপ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট, সে তার মুসলিম ভাইকে অপমান করে। আর প্রতিটি মুসলিমের জন্য তার অপর মুসলিম ভাইয়ের জান, মাল ও ইজ্জত-সম্মান হরণ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে”[25]।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
«لا تَبَاغَضُوا وَلا تَدَابَرُوا وَلا تَنَاجَشُوا ولايَبعْ بَعضُكُمْ عَلى بَيعِ بعضٍ وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إخوانَاً ».
“তোমরা একে অপরকে ঘৃণা করো না, দালালি করো না, তোমাদের কেউ অন্য কারো কেনা-বেচার উপর কেনা-বেচা করবে না। আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা ভাই ভাই হয়ে যাও”[26]।[27]

পাঁচ. মুসলিম ভাইদের ইজ্জত ও সম্মান করা, তাদের কোন প্রকার খাটো না করা[28] এবং তাদের কোন দোষ-ত্রুটি প্রকাশ না করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, 
 ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَسۡخَرۡ قَوۡمٞ مِّن قَوۡمٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُونُواْ خَيۡرٗا مِّنۡهُمۡ وَلَا نِسَآءٞ مِّن نِّسَآءٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُنَّ خَيۡرٗا مِّنۡهُنَّۖ وَلَا تَلۡمِزُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَلَا تَنَابَزُواْ بِٱلۡأَلۡقَٰبِۖ بِئۡسَ ٱلِٱسۡمُ ٱلۡفُسُوقُ بَعۡدَ ٱلۡإِيمَٰنِۚ وَمَن لَّمۡ يَتُبۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ١١ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱجۡتَنِبُواْ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلظَّنِّ إِنَّ بَعۡضَ ٱلظَّنِّ إِثۡمٞۖ وَ لَا تَجَسَّسُواْ وَلَا يَغۡتَب بَّعۡضُكُم بَعۡضًاۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمۡ أَن يَأۡكُلَ لَحۡمَ أَخِيهِ مَيۡتٗا فَكَرِهۡتُمُوهُۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ تَوَّابٞ رَّحِيمٞ ١٢﴾ [سورة الحجرات : 11-12].
“হে ঈমান-দারগণ, কোন সম্প্রদায় যেন অপর কোন সম্প্রদায়কে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপ কারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোন নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপ কারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতনা নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা করে না, তারাই তো যালিম। হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোস্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুল কারী, অসীম দয়ালু”[29]। [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ১১-১২]

ছয়. বিপদ-আপদ, সুখে-দুঃখে মুমিনদের সাথে থাকা:
মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের পরিচয় হল, সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ ও মসিবতের সময় মুমিনদের সাথে থাকা। তাদের কোনো বিপদে এগিয়ে আসা। কিন্তু যারা মুনাফেক তারা মুমিনদের অবস্থা যখন ভালো দেখে, তখন তাদের সাথে থাকে। আর যখন দেখে মুমিনদের উপর কোন বিপর্যয় বা বিপদ নেমে আসছে, তখন তারা তাদের সঙ্গ ছেড়ে দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুনাফেকদের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেন, 
﴿ٱلَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمۡ فَإِن كَانَ لَكُمۡ فَتۡحٞ مِّنَ ٱللَّهِ قَالُوٓاْ أَلَمۡ نَكُن مَّعَكُمۡ وَإِن كَانَ لِلۡكَٰفِرِينَ نَصِيبٞ قَالُوٓاْ أَلَمۡ نَسۡتَحۡوِذۡ عَلَيۡكُمۡ وَنَمۡنَعۡكُم مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَۚ فَٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ وَلَن يَجۡعَلَ ٱللَّهُ لِلۡكَٰفِرِينَ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ سَبِيلًا ١٤١﴾ [سورة النساء :141].
“যারা তোমাদের ব্যাপারে [অকল্যাণের] অপেক্ষায় থাকে, অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি তোমাদের বিজয় হয় তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না’? আর যদি কাফিরদের আংশিক বিজয় হয়, তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করিনি এবং মুমিনদের কবল থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করিনি’? সুতরাং, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার করবেন। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কখনো মুমিনদের বিপক্ষে কাফিরদের জন্য পথ রাখবেন না”। [সূরা, আয়াত: ১৪১]

সাত. মুমিনদের সাথে সাক্ষাত করা, তাদের সাক্ষাতকে পছন্দ করা এবং তাদের সাথে মিলে-মিশে থাকা [30]:
হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
  « وَجَبَتْ مَحَبَّتِي للْمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ ».
“আমার উপর ঐ সব লোকদের জন্য মহব্বত করা ওয়াজিব, যারা একমাত্র আমি আল্লাহর মহব্বতের কারণে পরস্পর পরস্পরকে দেখতে যায়”[31]।
যে ব্যক্তি তার কোন মুমিন ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে মহব্বত করে, তাকেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহব্বত করেন। অপর এক হাদিসে বর্ণিত,
 «أَنَّ رَجُلاً زَارَ أَخاً لَهُ فِي اللهِ فَأَرْصَدَ اللَّهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكاً فسأله أَيْنَ تُرِيدُ ؟ قَالَ: أزورُ أَخاً لِي فِي اللهِ، قَالَ هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا قَالَ: لَا ، غَيْرَ أَنِّي أَحْبَبْتُهُ فِي اللَّهِ قَالَ: فَإِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ »
“এক ব্যক্তি তার একজন ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তার চলার পথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একজন ফেরেশতাকে পাঠান। ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যান? জওয়াবে সে বলল, আমি আমার একজন দীনি ভাইকে দেখতে যাই। ফেরেশতা বলল, তার উপর তোমার কোন অনুদান আছে কিনা যা তুমি ভোগ কর? বলল না। আমি তাকে একমাত্র আল্লাহর জন্য মহব্বত করি। তখন ফেরেশতা তাকে ডেকে বলল, আমি তোমার নিকট আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে বিশেষ দূত হিসেবে সু-সংবাদ দিতে এসেছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাকে মহব্বত করে, যেমনটি তুমি তোমার ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে মহব্বত কর[32]।  

আট. মুমিনদের অধিকারের প্রতি সম্মান পদর্শন করা:
মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের নিদর্শন হল, তাদের হক ও অধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এবং তাদের অধিকারের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করা[33]। সুতরাং কোনো মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় করবে না, তাদের দরাদরির উপর দরাদরি করবে না, তাদের বিবাহের প্রস্তাবের উপর নিজের বিয়ের প্রস্তাব দিবে না, তারা মুবাহ বা জায়েয যে সব কাজে রত হয়েছে সে সব কাজে তাদের উপর নিজেকে প্রাধান্য দিবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ألالايَبعْ الرَّجُلُ عَلَى بَيْعِ أَخِيهِ وَلَا يَخْطُبُ عَلَى خِطبَتِهِ »
“সাবধান! কেউ যেন তার ভাইয়ের বিক্রির উপর বিক্রি না করে, আর কারো প্রস্তাবের উপর কোন প্রস্তাব না দেয়”[34]। অপর বর্ণনায় এসেছে,
  « ولايَسُمْ على سَوْمِهِ »
“কারো মুলা-মূলী করার উপর যেন মুলা-মূলী না করে”[35]।

নয়. দুর্বল মুমিনদের প্রতি দয়াবান হওয়া:
যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
  « لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يُوَقِّرْ كَبِيرَنَا وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا »
“যারা বড়দের সম্মান করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”[36]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
« هل تُنْصَرُونَ وتُرْزَقُونَ إلابِضُعَفَائِكُمْ »
“তোমাদের মধ্যে যারা দুর্বল, অকর্মা ও অসহায়, তাদের বরকতেই তোমাদের রিজিক দেয়া হয় এবং সহযোগিতা করা হয়[37]। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
 ﴿وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ وَلَا تَعۡدُ عَيۡنَاكَ عَنۡهُمۡ تُرِيدُ زِينَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا﴾ [سورة الكهف:28]
“আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এবং দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে। তোমার দু’চোখ যেন তাদের থেকে ঘুরে না যায়। [সূরা কাহাফ, আয়াত: ২৮]

দশ. মুমিনদের জন্য দো‘আ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَٱسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۢبِكَ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ﴾ [سورة محمد: 19].
“আর তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য।”।
 আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ ﴾ [سورة الحشر: 10].
“হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন”।

সতর্কতা
এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নিম্নবর্ণিত বাণীটি নিয়ে একটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়ে থাকে, তার ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মতামত ও আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হল।
﴿لَّا يَنۡهَىٰكُمُ ٱللَّهُ عَنِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ وَلَمۡ يُخۡرِجُوكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ أَن تَبَرُّوهُمۡ وَتُقۡسِطُوٓاْ إِلَيۡهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ ٨﴾ [سورة الممتحنة:8].
“দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় পরায়ণদেরকে ভালবাসেন”। [সূরা আল-মুমতাহানা, আয়াত: ৮]
আয়াতের অর্থ হল, যে সব কাফেররা মুমিনদের কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সাথী হয়ে যুদ্ধ করে না এবং মুসলিমদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি হতে বের করে দেয় না, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। মুসলিমরা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে দুনিয়াবি যে সব মুয়ামালা বা লেনদেন আছে তাতে তারা তাদের সাথে ইনসাফ ভিত্তিক আচরণ করবে, তাদের সাথে কোন প্রকার অনৈতিক আচরণ করবে না। কিন্তু তাদের অন্তর দিয়ে মহব্বত করা যাবে না। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এখানে ( أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ) “তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে” বলেছেন, এ কথা বলেননি ‘তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে এবং মহব্বত করবে’।
একই কথা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফের মাতা-পিতা সম্পর্কেও বলেন,
 ﴿وَإِن جَٰهَدَاكَ عَلَىٰٓ أَن تُشۡرِكَ بِي مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٞ فَلَا تُطِعۡهُمَاۖ وَصَاحِبۡهُمَا فِي ٱلدُّنۡيَا مَعۡرُوفٗاۖ وَٱتَّبِعۡ سَبِيلَ مَنۡ أَنَابَ إِلَيَّۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ١٥﴾ [سورة لقمان:15].
“আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শির্ক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে। আর অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৫]   
    «وقد جاءَتْ أُمُ أَسْمَاءَ إليها تطلُبُ صِلَتَها وهيَ كافِرةٌ فَاستَأذَنتْ أسماءُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم  في ذلك فَقَالَ لها: صِلِي أُمَّكِ »
হাদিসে বর্ণিত, আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মাতা কাফের অবস্থায় তার নিকট এসে সহযোগিতা চাইল এবং সহানুভূতি কামনা করল। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে সহযোগিতা করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট অনুমতি চাইলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সহযোগিতা করার অনুমতি দেন এবং তিনি তাকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি তোমার মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার কর[38] অপর এক আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
 ﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ﴾ [ سورة المجادلة:22].
“যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র--- হয় তবুও।” [সূরা মুজাদালাহ্‌, আয়াত: ২২]
মোটকথা, অমুসলিম, কাফের ও মুশরিকদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও দুনিয়াবি কোন লেন-দেনে তাদের সাথে ভালো ও উত্তম ব্যবহার করা আর তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা ও তাদেরকে অন্তর থেকে মহব্বত করা, দুটি জিনিস এক নয়, দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। তাদের মহব্বত করা এক বিষয় আর দুনিয়াবি মুয়ামেলা করা ভিন্ন বিষয়।
কারণ, অমুসলিমদের সাথে ইনসাফ ভিত্তিক আচরণ করা তাদেরকে পরোক্ষভাবে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেয়া হয়ে যায়। তাদের সাথে ভালো লেন-দেন করা এবং আত্মীয়তা বজায় রাখার ফলে তাদের মধ্যে ইসলামের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বেড়ে যায়[39]। কিন্তু তাদের অন্তর থেকে মহব্বত করা এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা দ্বারা তাদের কুফরের প্রতি সন্তুষ্টি ও স্বীকৃতি বুঝায়। আর এটি কারণ হয় তাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত না দেয়ার। 
এখানে আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে, তা হল, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা হারাম হওয়ার অর্থ এ নয়, কাফেরদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানি কেনা-বেচা ইত্যাদি সবই নিষিদ্ধ। তাদের আবিষ্কৃত কোন বস্তু দ্বারা আমরা কোন উপকার হাসিল করতে পারব না এবং তাদের অভিজ্ঞতা ও টেকনোলজিকে আমরা আমাদের প্রয়োজনে কোন কাজে লাগাতে পারব না এমনটিও নয়। বরং তাদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, দুনিয়াবি কোন লেন-দেন ইত্যাদিতে কোন অসুবিধা নাই। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কাফেরদের সাথে লেন-দেন করেছেন। অমুসলিমদের থেকে তিনি ঋণ গ্রহণ করেছেন, বেচা-কেনা করেছেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম [আব্দুল্লাহ্‌] ইব্‌ন উরাইকিত আল-লাইসী নামক একজন কাফেরকে টাকার বিনিময়ে ভাড়া নেন, যাতে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাস্তা দেখায়। অনুরূপভাবে একজন ইয়াহূদী থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। সুতরাং এ সব হাদিস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, অমুসলিমদের সাথে দুনিয়াবি লেন-দেন করাতে কোন অসুবিধা নাই। মুসলিমদের সাথে যেভাবে লেন-দেন করা হয়, অনুরূপভাবে অমুসলিমদের সাথেও একইভাবে লেন-দেন করতে হবে। মুসলিমরা এ যাবত কাল পর্যন্ত কাফেরদের থেকে মালামাল ক্রয় করে আসছে, অমুসলিম দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র-পাতি আমদানি করছে, এগুলো সবই হল, তাদের থেকে টাকার বিনিময়ে কোন কিছু ক্রয় করা। এতে তারা আমাদের উপর কোন প্রকার প্রাধান্য বিস্তার করতে পারবে না এবং এর কারণে তারা আমাদের উপর কোন প্রকার ফযিলত লাভ করতে পারবে না। অমুসলিমদের সাথে এ ধরনের লেন-দেন করা, তাদের মহব্বত করা বা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করার প্রমাণ বা কারণ নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের মহব্বত করা ও তাদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে ওয়াজিব করেছেন, পক্ষান্তরে কাফেরদের ঘৃণা করা তাদের বিরোধিতা করাকেও ওয়াজিব করেছেন। [কিন্তু তাদের সাথে লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও দুনিয়াবি কোন মুয়ামালাকে হারাম বা নিষেধ করেন নি।] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
 ﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ ءَاوَواْ وَّنَصَرُوٓاْ أُوْلَٰٓئِكَ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يُهَاجِرُواْ مَا لَكُم مِّن وَلَٰيَتِهِم مِّن شَيۡءٍ حَتَّىٰ يُهَاجِرُواْۚ وَإِنِ ٱسۡتَنصَرُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ فَعَلَيۡكُمُ ٱلنَّصۡرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوۡمِۢ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَٰقٞۗ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٧٢ وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٍۚ إِلَّا تَفۡعَلُوهُ تَكُن فِتۡنَةٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَفَسَادٞ كَبِيرٞ ٧٣﴾ [سورة الأنفال:73].
“নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং নিজদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহর  রাস্তায় জিহাদ করেছে আর যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সহায়তা করেছে, তারা একে অপরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে, কিন্তু হিজরত করেনি, তাদেরকে সাহায্যের কোন দায়িত্ব তোমাদের নেই, যতক্ষণ না তারা হিজরত করে। আর যদি তারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের নিকট কোন সহযোগিতা চায়, তাহলে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে এমন কওমের বিরুদ্ধে নয়, যাদের সাথে তোমাদের একে অপরের চুক্তি রয়েছে এবং তোমরা যে আমল কর, তার ব্যাপারে আল্লাহ পূর্ণ দৃষ্টিমান। আর যারা কুফরি করে, তারা একে অপরের বন্ধু। যদি তোমরা তা না কর, তাহলে জমিনে ফিতনা ও বড় ফ্যাসাদ হবে”। [সূরা আনফাল, আয়াত: ৭২,৭৩]
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের   বাণী- ﴿إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ﴾ “যদি তোমরা মুশরিকদের থেকে আলাদা না থাক এবং মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব না কর, তখন মানুষের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি হবে”। আর তা হল, বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি হবে, [সমাজের নিয়ম কানুন ঠিক থাকবে না], মুমিনরা কাফেরদের সাথে মিশে যাবে। ফলে মুমিনদের স্বকীয়তা বজায় থাকবে না। তখন সমাজে অনেক ফিতনা ফ্যাসাদ দেখা দেবে, সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে---”।  বর্তমানে সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। আল্লাহ আমাদের সহযোগিতা করুক।
[20] যারা দুর্বল হিজরত করতে সক্ষম নয়, তারা যদি তাদের অপারগতার কারণে হিজরত করতে না পারে, তাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফের মুলুকে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। তবে যখন তারা সামর্থ্য লাভ করবে, তখন তাদের অবশ্যই হিজরত করতে হবে এবং হিজরত করার সৌভাগ্য লাভ করতে হবে। তবে হিজরত করা কোন কাপুরুষতা কিংবা দুশমনের ভয়ে পলায়ন নয়, হিজরত হল, আল্লাহর দ্বীনের সংরক্ষণ করার লক্ষে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করে কাফেরদের বিপক্ষে শক্তি অর্জন করা ও দ্বীনের উপর অটল অবিচল থাকার উন্নত কৌশল। [অনুবাদক]।
[21] একজন মুমিন তার অপর মুমিন ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসবে, তাদের কল্যাণ কামনা করবে এবং তাদের বিপদে এগিয়ে আসবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  মুমিনদের মধ্যে বন্ধুত্ব কায়েম করে দিয়েছেন। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, তাদের ঈমানী বন্ধন অটুট।
[22] একজন ঈমানদার ব্যক্তি তার অপর ঈমানদার ভাইয়ের আনন্দে আনন্দিত হবে। ঈমানদার মুমিনের সফলতাকে তার নিজের সফলতা মনে করবে। পক্ষান্তরে তাদের কোন বিপদকে তার নিজের বিপদ বলে মনে করবে। জান-মাল দিয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। মুমিন পৃথিবীর যে প্রান্তে হোক না কেন, সে তার ভাই। তার কোন সমস্যায় আমাকে অবশ্যই অশ্রু জরাতে হবে। তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে।
[23] মুসলিম কিতাবুল বির ওয়াসসিলা, পরিচ্ছেদ: মুমিনদের প্রতি দয়া করা, তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা। মুসনাদে আহমতে ইমাম আহমদ রহ. নুমান ইব্ন বাশির থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন।
[24] তুমি তোমার নিজের জন্য যা অপছন্দ করবে, তোমার অপর ভাইয়ের জন্যও তা অপছন্দ করবে। আর তুমি তোমার নিজের জন্য যা মহব্বত করবে, তুমি তোমার নিজের জন্যও তা মহব্বত করবে। তখনই তুমি সত্যিকার ঈমানদার হতে পারবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অবস্থা খুবই করুণ। আমরা নিজেদের স্বার্থের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে পারি। কিন্তু আমার অপর ভাইয়ের উপকারের জন্য একটু মাথাও ঘামাতে পারি না।
[25] .বুখারি, কিতাবুল মাজালিম, পরিচ্ছেদ: একজন মুসলিম অপর মুসলিমের উপর অত্যাচার করবে না এবং তাকে দুশমনের হাদে তুলে দেবে না। মুসলিম, কিতাবুল বির ওয়াসসিলা ওয়াল আদাব। পরিচ্ছেদ: মুসলিমের উপর জুলুম অত্যাচার করা হারাম হওয়া বিষয়ে।
[26] বুখারি কিতাবুল আদব। পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তাআলার বাণী:  ياأيها الذين آمنوا اجتنبوا كثيراً من الظن মুসলিম কিতাবুল বির ওয়াস সিলা, পরিচ্ছেদ: খারাপ ধারণা করা, চোগলখোরি করা ও ধোকা দেয়া হারাম হওয়া বিষয়ে আলোচনা। আর তানাযুশ বলা হয়, পণ্যের দাম বেশি হেঁকে বাড়িয়ে দিয়ে অপরকে ধোকায় ফেলা।
[27] ইসলাম এমন এক দ্বীন যা কোন মানুষের ন্যূনতম অধিকার লঙ্ঘন করাকে বরদাশত করে না। উল্লেখিত হাদীসদ্বয় তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এখানে বলা হয়েছে, কারো বেচা-কেনার উপর বেচা-কেনার উপর বেচা-বিক্রি করা যাবে না। কারো অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। শুধু তাই নয়, ইসলামের আদর্শ হল, তোমার নিজের অধিকারের উপর তোমার অপর ভাইয়ের অধিকারকে প্রাধান্য দেবে।
[28] ইসলামের অন্যতম আদর্শ হল, কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা হতে বিরত থাকা। কাউকে ছোট মনে করা যাবে না। হতে পারে তুমি যাকে ছোট মনে করছ, সে তোমার থেকে বড়। কারণ, কে বড় আর কে ছোট তা মানুষের নিকট স‎

মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের নিদর্শন
এক. কাফের দেশ ছেড়ে মুসলিম দেশে হিজরত করা:
হিজরত হল, দ্বীনকে রক্ষার তাগিদে কাফের দেশ থেকে মুসলিম দেশে চলে আসা।
এখানে হিজরতের যে অর্থ ও উদ্দেশ্য আলোচনা করা হয়েছে, সে অর্থ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে হিজরত করা প্রতিটি মুসলিমের উপর ওয়াজিব এবং এ অর্থ ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী হিজরত করার বিধান কিয়ামত পর্যন্ত বাকী থাকবে। যারা হিজরত করতে সক্ষম তারপরও মুশরিকদের মাঝে অবস্থান করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে নিজেকে দায়িত্বমুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন। তবে যদি এমন হয় যে হিজরত করতে সক্ষম নয়, বা সেখানে অবস্থানের পিছনে কোন দীনি উদ্দেশ্য থাকে যেমন- আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া, ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য কাজ করা ইত্যাদি তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ تَوَفَّىٰهُمُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ ظَالِمِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَالُواْ فِيمَ كُنتُمۡۖ قَالُواْ كُنَّا مُسۡتَضۡعَفِينَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ قَالُوٓاْ أَلَمۡ تَكُنۡ أَرۡضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةٗ فَتُهَاجِرُواْ فِيهَاۚ فَأُوْلَٰٓئِكَ مَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ٩٧ إِلَّا ٱلۡمُسۡتَضۡعَفِينَ مِنَ ٱلرِّجَالِ وَٱلنِّسَآءِ وَٱلۡوِلۡدَٰنِ لَا يَسۡتَطِيعُونَ حِيلَةٗ وَلَا يَهۡتَدُونَ سَبِيلٗا ٩٨ فَأُوْلَٰٓئِكَ عَسَى ٱللَّهُ أَن يَعۡفُوَ عَنۡهُمۡۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَفُوًّا غَفُورٗا ٩٩﴾ ] سورة النساء:97-98].
“নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কি অবস্থায় ছিলে’? তারা বলে, ‘আমরা জমিনে দুর্বল ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে’? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তন স্থল। তবে যে দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন রাস্তা খুঁজে পায় না। অতঃপর আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ মার্জনা-কারী, ক্ষমাশীল”[20]। [সূরা নিসা, আয়াত: ৯৭, ৯৮]
দুই. মুসলিমদের সাহায্য করা এবং জান, মাল ও জবান দ্বারা তাদের দীনি ও দুনিয়াবি বিষয়ে সহযোগিতা করা[21]:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖ﴾ [سورة التوبة: 71]
“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু”। [সূরা তাওবা, আয়াত: ৭১]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿وَإِنِ ٱسۡتَنصَرُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ فَعَلَيۡكُمُ ٱلنَّصۡرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوۡمِۢ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَٰقٞۗ﴾ [سورة الأنفال :72]
“আর যদি তারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের নিকট কোন সহযোগিতা চায়, তাহলে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে এমন কওমের বিরুদ্ধে নয়, যাদের সাথে তোমাদের একে অপরের চুক্তি রয়েছে”। [সূরা আনফাল, আয়াত: ৭২]
তিন. ঈমানদার ব্যথায় ব্যথিত হওয়া এবং তাদের সুখে খুশি হওয়া[22]:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بالْحُمَّى والسَّهَرِ »
“মুমিনদের দৃষ্টান্ত পরস্পর মহব্বত, দয়া ও সহানুভূতির দিক দিক দিয়ে, একই দেহের মত, তার দেহের একটি অঙ্গ যদি আক্রান্ত হয়, তখন তার সারা শরীর আক্রান্ত হয়। সে সারা শরীরে জ্বর অনুভব করে এবং অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়”[23]।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
« الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضاً وَشَبَّكَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ »
“মুমিনরা মুমিনের জন্য একটি দেয়ালের মত; তার এক অংশ অপর অংশকে শক্তি জোগান দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা কলে উভয় হাতের আঙ্গুলগুলোকে একত্র করে দেখান”।
চার. ঈমানদারদের হিতাকাঙ্খি হওয়া, তাদের কল্যাণকামী হওয়া, তাদের সাথে কোন প্রকার প্রতারণা না করা এবং তাদের কোন প্রকার ধোঁকা না দেওয়া:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ».
“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমার নিজের জন্য যা পছন্দ কর তা তোমার ভাইয়ের জন্যও পছন্দ কর”[24]। [বুখারি কিতাবুল মাযালিম: পরিচ্ছেদ: মজলুমকে সাহায্য করা বিষয়ে আলোচনা।]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
« الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَحْقِرُهُ وَلَا يَخْذُلُهُ ولايُسْلِمُهُ ، بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنْ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ ، كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ »
“একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই স্বরূপ। মুসলিম হিসেবে সে তার অপর ভাইকে অপমান করতে পারে না, তিরস্কার করতে পারে না এবং তাকে দুশমনের হাতে সোপর্দ করতে পারে না। একজন মানুষ খারাপ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট, সে তার মুসলিম ভাইকে অপমান করে। আর প্রতিটি মুসলিমের জন্য তার অপর মুসলিম ভাইয়ের জান, মাল ও ইজ্জত-সম্মান হরণ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে”[25]।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
«لا تَبَاغَضُوا وَلا تَدَابَرُوا وَلا تَنَاجَشُوا ولايَبعْ بَعضُكُمْ عَلى بَيعِ بعضٍ وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إخوانَاً ».
“তোমরা একে অপরকে ঘৃণা করো না, দালালি করো না, তোমাদের কেউ অন্য কারো কেনা-বেচার উপর কেনা-বেচা করবে না। আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা ভাই ভাই হয়ে যাও”[26]।[27]
পাঁচ. মুসলিম ভাইদের ইজ্জত ও সম্মান করা, তাদের কোন প্রকার খাটো না করা[28] এবং তাদের কোন দোষ-ত্রুটি প্রকাশ না করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَسۡخَرۡ قَوۡمٞ مِّن قَوۡمٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُونُواْ خَيۡرٗا مِّنۡهُمۡ وَلَا نِسَآءٞ مِّن نِّسَآءٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُنَّ خَيۡرٗا مِّنۡهُنَّۖ وَلَا تَلۡمِزُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَلَا تَنَابَزُواْ بِٱلۡأَلۡقَٰبِۖ بِئۡسَ ٱلِٱسۡمُ ٱلۡفُسُوقُ بَعۡدَ ٱلۡإِيمَٰنِۚ وَمَن لَّمۡ يَتُبۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ١١ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱجۡتَنِبُواْ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلظَّنِّ إِنَّ بَعۡضَ ٱلظَّنِّ إِثۡمٞۖ وَ لَا تَجَسَّسُواْ وَلَا يَغۡتَب بَّعۡضُكُم بَعۡضًاۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمۡ أَن يَأۡكُلَ لَحۡمَ أَخِيهِ مَيۡتٗا فَكَرِهۡتُمُوهُۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ تَوَّابٞ رَّحِيمٞ ١٢﴾ [سورة الحجرات : 11-12].
“হে ঈমান-দারগণ, কোন সম্প্রদায় যেন অপর কোন সম্প্রদায়কে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপ কারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোন নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপ কারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতনা নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা করে না, তারাই তো যালিম। হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোস্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুল কারী, অসীম দয়ালু”[29]। [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ১১-১২]
ছয়. বিপদ-আপদ, সুখে-দুঃখে মুমিনদের সাথে থাকা:
মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের পরিচয় হল, সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ ও মসিবতের সময় মুমিনদের সাথে থাকা। তাদের কোনো বিপদে এগিয়ে আসা। কিন্তু যারা মুনাফেক তারা মুমিনদের অবস্থা যখন ভালো দেখে, তখন তাদের সাথে থাকে। আর যখন দেখে মুমিনদের উপর কোন বিপর্যয় বা বিপদ নেমে আসছে, তখন তারা তাদের সঙ্গ ছেড়ে দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুনাফেকদের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেন,
﴿ٱلَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمۡ فَإِن كَانَ لَكُمۡ فَتۡحٞ مِّنَ ٱللَّهِ قَالُوٓاْ أَلَمۡ نَكُن مَّعَكُمۡ وَإِن كَانَ لِلۡكَٰفِرِينَ نَصِيبٞ قَالُوٓاْ أَلَمۡ نَسۡتَحۡوِذۡ عَلَيۡكُمۡ وَنَمۡنَعۡكُم مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَۚ فَٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ وَلَن يَجۡعَلَ ٱللَّهُ لِلۡكَٰفِرِينَ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ سَبِيلًا ١٤١﴾ [سورة النساء :141].
“যারা তোমাদের ব্যাপারে [অকল্যাণের] অপেক্ষায় থাকে, অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি তোমাদের বিজয় হয় তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না’? আর যদি কাফিরদের আংশিক বিজয় হয়, তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করিনি এবং মুমিনদের কবল থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করিনি’? সুতরাং, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার করবেন। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কখনো মুমিনদের বিপক্ষে কাফিরদের জন্য পথ রাখবেন না”। [সূরা, আয়াত: ১৪১]
সাত. মুমিনদের সাথে সাক্ষাত করা, তাদের সাক্ষাতকে পছন্দ করা এবং তাদের সাথে মিলে-মিশে থাকা [30]:
হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
« وَجَبَتْ مَحَبَّتِي للْمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ ».
“আমার উপর ঐ সব লোকদের জন্য মহব্বত করা ওয়াজিব, যারা একমাত্র আমি আল্লাহর মহব্বতের কারণে পরস্পর পরস্পরকে দেখতে যায়”[31]।
যে ব্যক্তি তার কোন মুমিন ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে মহব্বত করে, তাকেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহব্বত করেন। অপর এক হাদিসে বর্ণিত,
«أَنَّ رَجُلاً زَارَ أَخاً لَهُ فِي اللهِ فَأَرْصَدَ اللَّهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكاً فسأله أَيْنَ تُرِيدُ ؟ قَالَ: أزورُ أَخاً لِي فِي اللهِ، قَالَ هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا قَالَ: لَا ، غَيْرَ أَنِّي أَحْبَبْتُهُ فِي اللَّهِ قَالَ: فَإِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ »
“এক ব্যক্তি তার একজন ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তার চলার পথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একজন ফেরেশতাকে পাঠান। ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যান? জওয়াবে সে বলল, আমি আমার একজন দীনি ভাইকে দেখতে যাই। ফেরেশতা বলল, তার উপর তোমার কোন অনুদান আছে কিনা যা তুমি ভোগ কর? বলল না। আমি তাকে একমাত্র আল্লাহর জন্য মহব্বত করি। তখন ফেরেশতা তাকে ডেকে বলল, আমি তোমার নিকট আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে বিশেষ দূত হিসেবে সু-সংবাদ দিতে এসেছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাকে মহব্বত করে, যেমনটি তুমি তোমার ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে মহব্বত কর[32]।
আট. মুমিনদের অধিকারের প্রতি সম্মান পদর্শন করা:
মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের নিদর্শন হল, তাদের হক ও অধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এবং তাদের অধিকারের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করা[33]। সুতরাং কোনো মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় করবে না, তাদের দরাদরির উপর দরাদরি করবে না, তাদের বিবাহের প্রস্তাবের উপর নিজের বিয়ের প্রস্তাব দিবে না, তারা মুবাহ বা জায়েয যে সব কাজে রত হয়েছে সে সব কাজে তাদের উপর নিজেকে প্রাধান্য দিবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ألالايَبعْ الرَّجُلُ عَلَى بَيْعِ أَخِيهِ وَلَا يَخْطُبُ عَلَى خِطبَتِهِ »
“সাবধান! কেউ যেন তার ভাইয়ের বিক্রির উপর বিক্রি না করে, আর কারো প্রস্তাবের উপর কোন প্রস্তাব না দেয়”[34]। অপর বর্ণনায় এসেছে,
« ولايَسُمْ على سَوْمِهِ »
“কারো মুলা-মূলী করার উপর যেন মুলা-মূলী না করে”[35]।
নয়. দুর্বল মুমিনদের প্রতি দয়াবান হওয়া:
যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يُوَقِّرْ كَبِيرَنَا وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا »
“যারা বড়দের সম্মান করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”[36]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
« هل تُنْصَرُونَ وتُرْزَقُونَ إلابِضُعَفَائِكُمْ »
“তোমাদের মধ্যে যারা দুর্বল, অকর্মা ও অসহায়, তাদের বরকতেই তোমাদের রিজিক দেয়া হয় এবং সহযোগিতা করা হয়[37]। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ وَلَا تَعۡدُ عَيۡنَاكَ عَنۡهُمۡ تُرِيدُ زِينَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا﴾ [سورة الكهف:28]
“আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এবং দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে। তোমার দু’চোখ যেন তাদের থেকে ঘুরে না যায়। [সূরা কাহাফ, আয়াত: ২৮]
দশ. মুমিনদের জন্য দো‘আ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَٱسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۢبِكَ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ﴾ [سورة محمد: 19].
“আর তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য।”।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ ﴾ [سورة الحشر: 10].
“হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন”।
সতর্কতা
এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নিম্নবর্ণিত বাণীটি নিয়ে একটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়ে থাকে, তার ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মতামত ও আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হল।
﴿لَّا يَنۡهَىٰكُمُ ٱللَّهُ عَنِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ وَلَمۡ يُخۡرِجُوكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ أَن تَبَرُّوهُمۡ وَتُقۡسِطُوٓاْ إِلَيۡهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ ٨﴾ [سورة الممتحنة:8].
“দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় পরায়ণদেরকে ভালবাসেন”। [সূরা আল-মুমতাহানা, আয়াত: ৮]
আয়াতের অর্থ হল, যে সব কাফেররা মুমিনদের কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সাথী হয়ে যুদ্ধ করে না এবং মুসলিমদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি হতে বের করে দেয় না, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। মুসলিমরা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে দুনিয়াবি যে সব মুয়ামালা বা লেনদেন আছে তাতে তারা তাদের সাথে ইনসাফ ভিত্তিক আচরণ করবে, তাদের সাথে কোন প্রকার অনৈতিক আচরণ করবে না। কিন্তু তাদের অন্তর দিয়ে মহব্বত করা যাবে না। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এখানে ( أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ) “তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে” বলেছেন, এ কথা বলেননি ‘তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে এবং মহব্বত করবে’।
একই কথা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফের মাতা-পিতা সম্পর্কেও বলেন,
﴿وَإِن جَٰهَدَاكَ عَلَىٰٓ أَن تُشۡرِكَ بِي مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٞ فَلَا تُطِعۡهُمَاۖ وَصَاحِبۡهُمَا فِي ٱلدُّنۡيَا مَعۡرُوفٗاۖ وَٱتَّبِعۡ سَبِيلَ مَنۡ أَنَابَ إِلَيَّۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ١٥﴾ [سورة لقمان:15].
“আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শির্ক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে। আর অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৫]
«وقد جاءَتْ أُمُ أَسْمَاءَ إليها تطلُبُ صِلَتَها وهيَ كافِرةٌ فَاستَأذَنتْ أسماءُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم في ذلك فَقَالَ لها: صِلِي أُمَّكِ »
হাদিসে বর্ণিত, আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মাতা কাফের অবস্থায় তার নিকট এসে সহযোগিতা চাইল এবং সহানুভূতি কামনা করল। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে সহযোগিতা করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট অনুমতি চাইলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সহযোগিতা করার অনুমতি দেন এবং তিনি তাকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি তোমার মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার কর[38] অপর এক আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ﴾ [ سورة المجادلة:22].
“যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র--- হয় তবুও।” [সূরা মুজাদালাহ্‌, আয়াত: ২২]
মোটকথা, অমুসলিম, কাফের ও মুশরিকদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও দুনিয়াবি কোন লেন-দেনে তাদের সাথে ভালো ও উত্তম ব্যবহার করা আর তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা ও তাদেরকে অন্তর থেকে মহব্বত করা, দুটি জিনিস এক নয়, দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। তাদের মহব্বত করা এক বিষয় আর দুনিয়াবি মুয়ামেলা করা ভিন্ন বিষয়।
কারণ, অমুসলিমদের সাথে ইনসাফ ভিত্তিক আচরণ করা তাদেরকে পরোক্ষভাবে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেয়া হয়ে যায়। তাদের সাথে ভালো লেন-দেন করা এবং আত্মীয়তা বজায় রাখার ফলে তাদের মধ্যে ইসলামের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বেড়ে যায়[39]। কিন্তু তাদের অন্তর থেকে মহব্বত করা এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা দ্বারা তাদের কুফরের প্রতি সন্তুষ্টি ও স্বীকৃতি বুঝায়। আর এটি কারণ হয় তাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত না দেয়ার।
এখানে আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে, তা হল, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা হারাম হওয়ার অর্থ এ নয়, কাফেরদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানি কেনা-বেচা ইত্যাদি সবই নিষিদ্ধ। তাদের আবিষ্কৃত কোন বস্তু দ্বারা আমরা কোন উপকার হাসিল করতে পারব না এবং তাদের অভিজ্ঞতা ও টেকনোলজিকে আমরা আমাদের প্রয়োজনে কোন কাজে লাগাতে পারব না এমনটিও নয়। বরং তাদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, দুনিয়াবি কোন লেন-দেন ইত্যাদিতে কোন অসুবিধা নাই। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কাফেরদের সাথে লেন-দেন করেছেন। অমুসলিমদের থেকে তিনি ঋণ গ্রহণ করেছেন, বেচা-কেনা করেছেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম [আব্দুল্লাহ্‌] ইব্‌ন উরাইকিত আল-লাইসী নামক একজন কাফেরকে টাকার বিনিময়ে ভাড়া নেন, যাতে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাস্তা দেখায়। অনুরূপভাবে একজন ইয়াহূদী থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। সুতরাং এ সব হাদিস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, অমুসলিমদের সাথে দুনিয়াবি লেন-দেন করাতে কোন অসুবিধা নাই। মুসলিমদের সাথে যেভাবে লেন-দেন করা হয়, অনুরূপভাবে অমুসলিমদের সাথেও একইভাবে লেন-দেন করতে হবে। মুসলিমরা এ যাবত কাল পর্যন্ত কাফেরদের থেকে মালামাল ক্রয় করে আসছে, অমুসলিম দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র-পাতি আমদানি করছে, এগুলো সবই হল, তাদের থেকে টাকার বিনিময়ে কোন কিছু ক্রয় করা। এতে তারা আমাদের উপর কোন প্রকার প্রাধান্য বিস্তার করতে পারবে না এবং এর কারণে তারা আমাদের উপর কোন প্রকার ফযিলত লাভ করতে পারবে না। অমুসলিমদের সাথে এ ধরনের লেন-দেন করা, তাদের মহব্বত করা বা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করার প্রমাণ বা কারণ নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের মহব্বত করা ও তাদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে ওয়াজিব করেছেন, পক্ষান্তরে কাফেরদের ঘৃণা করা তাদের বিরোধিতা করাকেও ওয়াজিব করেছেন। [কিন্তু তাদের সাথে লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও দুনিয়াবি কোন মুয়ামালাকে হারাম বা নিষেধ করেন নি।] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ ءَاوَواْ وَّنَصَرُوٓاْ أُوْلَٰٓئِكَ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يُهَاجِرُواْ مَا لَكُم مِّن وَلَٰيَتِهِم مِّن شَيۡءٍ حَتَّىٰ يُهَاجِرُواْۚ وَإِنِ ٱسۡتَنصَرُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ فَعَلَيۡكُمُ ٱلنَّصۡرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوۡمِۢ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَٰقٞۗ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٧٢ وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٍۚ إِلَّا تَفۡعَلُوهُ تَكُن فِتۡنَةٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَفَسَادٞ كَبِيرٞ ٧٣﴾ [سورة الأنفال:73].
“নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং নিজদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে আর যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সহায়তা করেছে, তারা একে অপরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে, কিন্তু হিজরত করেনি, তাদেরকে সাহায্যের কোন দায়িত্ব তোমাদের নেই, যতক্ষণ না তারা হিজরত করে। আর যদি তারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের নিকট কোন সহযোগিতা চায়, তাহলে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে এমন কওমের বিরুদ্ধে নয়, যাদের সাথে তোমাদের একে অপরের চুক্তি রয়েছে এবং তোমরা যে আমল কর, তার ব্যাপারে আল্লাহ পূর্ণ দৃষ্টিমান। আর যারা কুফরি করে, তারা একে অপরের বন্ধু। যদি তোমরা তা না কর, তাহলে জমিনে ফিতনা ও বড় ফ্যাসাদ হবে”। [সূরা আনফাল, আয়াত: ৭২,৭৩]
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বাণী- ﴿إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ﴾ “যদি তোমরা মুশরিকদের থেকে আলাদা না থাক এবং মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব না কর, তখন মানুষের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি হবে”। আর তা হল, বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি হবে, [সমাজের নিয়ম কানুন ঠিক থাকবে না], মুমিনরা কাফেরদের সাথে মিশে যাবে। ফলে মুমিনদের স্বকীয়তা বজায় থাকবে না। তখন সমাজে অনেক ফিতনা ফ্যাসাদ দেখা দেবে, সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে---”। বর্তমানে সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। আল্লাহ আমাদের সহযোগিতা করুক।
[20] যারা দুর্বল হিজরত করতে সক্ষম নয়, তারা যদি তাদের অপারগতার কারণে হিজরত করতে না পারে, তাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফের মুলুকে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। তবে যখন তারা সামর্থ্য লাভ করবে, তখন তাদের অবশ্যই হিজরত করতে হবে এবং হিজরত করার সৌভাগ্য লাভ করতে হবে। তবে হিজরত করা কোন কাপুরুষতা কিংবা দুশমনের ভয়ে পলায়ন নয়, হিজরত হল, আল্লাহর দ্বীনের সংরক্ষণ করার লক্ষে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করে কাফেরদের বিপক্ষে শক্তি অর্জন করা ও দ্বীনের উপর অটল অবিচল থাকার উন্নত কৌশল। [অনুবাদক]।
[21] একজন মুমিন তার অপর মুমিন ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসবে, তাদের কল্যাণ কামনা করবে এবং তাদের বিপদে এগিয়ে আসবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের মধ্যে বন্ধুত্ব কায়েম করে দিয়েছেন। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, তাদের ঈমানী বন্ধন অটুট।
[22] একজন ঈমানদার ব্যক্তি তার অপর ঈমানদার ভাইয়ের আনন্দে আনন্দিত হবে। ঈমানদার মুমিনের সফলতাকে তার নিজের সফলতা মনে করবে। পক্ষান্তরে তাদের কোন বিপদকে তার নিজের বিপদ বলে মনে করবে। জান-মাল দিয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। মুমিন পৃথিবীর যে প্রান্তে হোক না কেন, সে তার ভাই। তার কোন সমস্যায় আমাকে অবশ্যই অশ্রু জরাতে হবে। তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে।
[23] মুসলিম কিতাবুল বির ওয়াসসিলা, পরিচ্ছেদ: মুমিনদের প্রতি দয়া করা, তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা। মুসনাদে আহমতে ইমাম আহমদ রহ. নুমান ইব্ন বাশির থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন।
[24] তুমি তোমার নিজের জন্য যা অপছন্দ করবে, তোমার অপর ভাইয়ের জন্যও তা অপছন্দ করবে। আর তুমি তোমার নিজের জন্য যা মহব্বত করবে, তুমি তোমার নিজের জন্যও তা মহব্বত করবে। তখনই তুমি সত্যিকার ঈমানদার হতে পারবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অবস্থা খুবই করুণ। আমরা নিজেদের স্বার্থের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে পারি। কিন্তু আমার অপর ভাইয়ের উপকারের জন্য একটু মাথাও ঘামাতে পারি না।
[25] .বুখারি, কিতাবুল মাজালিম, পরিচ্ছেদ: একজন মুসলিম অপর মুসলিমের উপর অত্যাচার করবে না এবং তাকে দুশমনের হাদে তুলে দেবে না। মুসলিম, কিতাবুল বির ওয়াসসিলা ওয়াল আদাব। পরিচ্ছেদ: মুসলিমের উপর জুলুম অত্যাচার করা হারাম হওয়া বিষয়ে।
[26] বুখারি কিতাবুল আদব। পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তাআলার বাণী: ياأيها الذين آمنوا اجتنبوا كثيراً من الظن মুসলিম কিতাবুল বির ওয়াস সিলা, পরিচ্ছেদ: খারাপ ধারণা করা, চোগলখোরি করা ও ধোকা দেয়া হারাম হওয়া বিষয়ে আলোচনা। আর তানাযুশ বলা হয়, পণ্যের দাম বেশি হেঁকে বাড়িয়ে দিয়ে অপরকে ধোকায় ফেলা।
[27] ইসলাম এমন এক দ্বীন যা কোন মানুষের ন্যূনতম অধিকার লঙ্ঘন করাকে বরদাশত করে না। উল্লেখিত হাদীসদ্বয় তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এখানে বলা হয়েছে, কারো বেচা-কেনার উপর বেচা-কেনার উপর বেচা-বিক্রি করা যাবে না। কারো অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। শুধু তাই নয়, ইসলামের আদর্শ হল, তোমার নিজের অধিকারের উপর তোমার অপর ভাইয়ের অধিকারকে প্রাধান্য দেবে।
[28] ইসলামের অন্যতম আদর্শ হল, কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা হতে বিরত থাকা। কাউকে ছোট মনে করা যাবে না। হতে পারে তুমি যাকে ছোট মনে করছ, সে তোমার থেকে বড়। কারণ, কে বড় আর কে ছোট তা মানুষের নিকট স

No comments:

Post a Comment