হাদীস সহীহ হলে সেটিইআমার মাযহাব: একটি বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনা (পর্ব-১)
ইজহারুল ইসলাম
প্রত্যেক ইমামই বলেছেন, “ইযা সাহ্হাল হাদীস ফাহুয়া মাযহাবী” অর্থাৎ হাদীস সহীহ হলে সেটিই আমার মাযহাব। একথা উল্লেখ করে ডাক্তার জাকির নায়েক কিংবা অপরাপর আহলে হাদীস ও সালাফীগণ যুক্তি দিয়ে থাকেন, মাযহাবের অনুসরণ করা যাবে না, কেননা ইমামগণ সহীহ হাদীস অনুসরণের কথা বলেছেন।
ডাক্তার জাকির নায়েক একটু আগে বেড়ে বলেছেন,That’s the reason I say I am a hundred percent Hamboli, if Hamboli means the person who follows the teaching of Imam Ahmad Ibn Hambal, I am 100% Hamboli. Other people are 70%, 80%. So in these teachings, if you say, following the teachings of Imam Abu Hanifa, may Allah’s Mercy be on him, makes you a Hanafi, I am a ‘Pakka’ Hanafi, 100% Hanafi, if following the teachings of Imam Malek makes you a Maleki, I am 100% Maleki. If following the teachings of Imam Shafi, makes you a Shafi, I am 100% Shafi. If following the teachings of Imam Ahmad Ibn Hambol makes you a hamboli, I am a 100% ‘Sau fi Sad’ Hamboli. Because all these four great Aimmas said, if you find any of my fatwa that goes against Allah and his Rasul, throw my Fatwa on the wall.
“আমি বলি, আমি শতভাগ হাম্বলী। যদি কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুসরণের নাম হাম্বলী হয়, তবে আমি শতভাগ হাম্বলী। অন্যরা সত্তর ভাগ, কেউ আশি ভাগ, আমি একশ’ ভাগ হাম্বলী। যদি তুমি বলো, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর অনুসরণ করলে কেউ হানাফী হয়ে যায়, তবে আমি একশ’ ভাগ হানাফী। ইমাম মালেক (রহঃ) এর অনুসরণের কারণে কেউ যদি মালেকী হয়, তবে আমি শতভাগ মালেকী। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এর অনুসরণে কারণে কেউ যদি শাফেয়ী হয়, তবে আমি একশ’ ভাগ শাফেয়ী। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের অনুসরণের কারণে কেউ যদি হাম্বলী হয়, তবে আমি শতভাগ হাম্বলী। কেননা চার ইমামের প্রত্যেকেই বলেছেন, আমার ফতোয়া যদি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের (সঃ) বিরোধী হয়, তবে আমার ফতোয়া দেয়ালে ছুঁড়ে মার” এক. আমরা জানি যে, প্রত্যেক ইমামই বলেছেন, হাদীস সহীহ হলে সেটিই আমার মাযহাব।http://qaazi.wordpress.com/…/various-public-lectures-by-dr…/
বিবেচনার বিষয় হল, ইমামগণ যদি একথা নাও বলতেন, তবুও কি সকলের উপর রাসূলের (সঃ) এর সহীহ হাদীস অনুসরণ করা জরুরি নয়? কোন মু’মিন কি এ কথা বলার দুঃসাহস দেখাবে যে, আমি রাসূল (সঃ) এর সহীহ হাদীস পেলেও সেটা মানব না?
আমরা ডাঃ জাকির নায়েককে প্রশ্ন করব, কুরআনের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে কোন সন্দেহ আছে? কেউ যদি কোরআনের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ করে, নিঃসন্দেহে সে মুসলমান থাকবে না।
আমাদের কথা হল, কুরআন সুনিশ্চিতভাবে বিশুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কি কুরআনের সকল আয়াতের উপর আমল করে দেখাতে পারবেন? কারও জন্য কি কুরআনের সকল আয়াতের উপর আমল করা বৈধ?
সর্বজন স্বীকৃত বিষয় হল, কুরআন সুনিশ্চিতভাবে বিশুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কুরআনের সমস্ত আয়াতের উপর আমল করা বৈধ নয়। কেউ যদি কুরআনের সমস্ত আয়াতের উপর আমল করতে চায়, তবে সে সুনিশ্চিতভাবে গোমরাহ, পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।
আমরা সকলেই অবগত ইসলামের প্রাথমিক যুগে মদপান বৈধ ছিল। পবিত্র কুরআনে এ বৈধতা সম্পর্কে বলা হয়েছে-يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا
অর্থাৎ তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদেরকে বলুন, এতে মানুষের কল্যাণ ও বড় গোনাহ রয়েছে। আর এর গোনাহ তার কল্যাণের চেয়ে বড়। [সূরা বাকারা, আয়াত নং ২১৯]
তিরমিযি শরীফের হাদীসে রয়েছে- এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আয়াতটি হযরত উমর (রাঃ) এর সম্মুখে পাঠ করা হলে তিনি দু’য়া করলেন, اللهم بَيِّن لنا في الخمر بيان شفاء
“হে আল্লাহ! মদের ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দান করুন”অতঃপর পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ৪৩ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়। এ আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَقْرَبُوا الصَّلاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাযের নিকটবর্তী হয়ো না”এ আয়াতে শুধু নামাযের পূর্বে মদ খাওয়া অবৈধ করা হয়েছে।এ আয়াত হযরত উমরের সামনে তেলাওয়াত করা হলে, তিনি পূর্বের ন্যায় দু’আ করলেন, হে আল্লাহ মদের ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট বিধান দান করুন।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদার ৯০ও ৯১ নং আয়াত অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ পাক বলেছেন-يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (৯০) إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ (৯১)
অর্থঃ (৯০) হে মু’মিনগন! এই মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শর সমূহ শয়তানের অপবিত্র কাজ বৈ তো নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ প্রাপ্ত হও। (৯১) শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পর মাঝে শত্র“তা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্বরণ ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব, তোমরা কি নিবৃত্ত হবে?এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর হযরত উমর (রাঃ) বললেন,انتهينا، انتهينا“আমরা এ সমস্ত জিনিস থেকে বিরত হলাম, বিরত হলাম” [তিরমিযি, হাদীস নং ৩০৪৯]এখন কেউ যদি বলে, সূরা নিসার ৪৩ নং আয়াতে মাতাল অবস্থায় নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে, সুতরাং এ আয়াতে তো মদ হারাম একথা বলা হয়নি। মাতাল অবস্থায় নামায না পড়লেই আয়াতের উপর আমল হয়ে যাবে। সুতরাং নামায ব্যতীত অন্য সময়ে মদ পান করা বৈধ হবে।
সূরা বাকারার ২১৯ নং আয়াত, সূরা নিসার ৪৩ নং আয়াত, এগুলো কি সহীহ নয়? এগুলো কি কুরআনের আয়াত নয়? এ দু’ আয়াতের আলোকে কি ডাক্তার জাকির নায়েক মদ খাওয়া হালাল বলতে পারবেন? আর তিনি যদি হালাল বলেন, তবে তিনি মুসলমান থাকবেন? অথচ কুরআন সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, কোন কিছু সহীহ হলেই সেটি আমল যোগ্য নয়। চাই তা কুরআন হোক কিংবা হাদীস। কুরআনে যেমন নাসেখ-মানসুখ রয়েছে, রাসূল (সঃ) এর হাদীসেও নাসেখ-মানসুখ রয়েছে। আর এটি সর্বজন স্বীকৃত যে, মানসুখের (রহিত) উপর আমল করা নিষিদ্ধ এবং নাসেখের (রহিতকারী বিধান) উপর আমল করা আবশ্যক। এছাড়াও হাদীস বিশুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এমন অনেক গ্রহণযোগ্য কারণ রয়েছে, যার কারণে হাদীসটির উপর আমল করা হয় না। সুনির্দিষ্ট কারণে হাদীস পরিত্যাগ সত্ত্বেও অনেকে বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পেরে, নিজের অজ্ঞতাকে ইমামদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার কালজয়ী উক্তি-
وليعلم أنه ليس أحد من الأئمة المقبولين عند الأمة قبولا عاما يتعمد مخالفة رسول الله صلى الله عليه وسلم في شيء من سنته، دقيق ولا جليل، فإنهم متفقون اتفاقا يقينيا على وجوب اتباع الرسول وعلى أن كل أحد من الناس يؤخذ من قوله ويترك إلا رسول الله صلى الله عليه وسلم ولكن إذا وجد لواحد منهم قول قد جاء حديث صحيح بخلافه فلا بد له من عذر في تركه .
“প্রত্যেকের অবগত হওয়া জরুরি যে, মুসলিম উম্মাহের নিকট ব্যাপকভাবে সমাদৃত ইমামদের কোন ইমামই স্বেচ্ছায় রাসূলের কোন সুন্নতের বিরোধিতা করেননি। সুন্নতটি ছোট থেকে ছোট হোক কিংবা বড় থেকে বড়। কেননা তারা সন্দেহাতীত ও নিশ্চিতভাবে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, রাসূল (সঃ) এর অনুসরণ জরুরি এবং রাসূলের কথা ব্যতীত প্রত্যেকের কথাই যেমন গ্রহণ করা যায় আবার প্রত্যাখ্যানও করা যায়। কিন্তু তাদের কারও কাছ থেকে যদি এমন বক্তব্য পাওয়া যায়, যা কোন সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে বুঝতে হবে তার কাছে অবশ্যই যথার্থ কোন প্রমাণ বা ওজর রয়েছে, যার কারণে তিনি সহীহ হাদীসটি গ্রহণ করেননি।”
কিন্তু বর্তমান যুগের স্বশিক্ষিত তথাকথিত মুজতাহিদগণের অবস্থা কী? তাদের অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লামা আব্দুল গাফফার হিমসি (রহঃ) লিখেছেন-
لأنا نري في زماننا كثيرا ممن ينسب إلي العلم مغترا في نفسه ، يظن أنه فوق الثريا و هو في حضيض الأسفل، فربما يطالع كتابا من الكتب الستة-مثلا-فيري فيه حديثا مخالفا لمذهب أبي حنيفة فيقول: إضربوا مذهب أبي حنيفة علي عرض الحائط ، و خذوا بحديث رسول الله صلي الله عليه وسلم، وقد يكون هذا الحديث منسوخا أو معارضا بما هو أقوي منه سندا، أو نحو ذلك من موجبات عدم العمل به ، و هو لا يعلم بذلك , فلو فوض لمثل هؤلاء العمل بالحديث مطلقا: لضلوا في كثير من المسائل، وأضلوا من أثاهم من سائل
বর্তমান সময়ে অনেকেই নিজেকে বড় আলেম মনে করে ধোঁকায় পতিত রয়েছে। সে মনে করে যে, সে (ইলমের দিক থেকে) ছুরাইয়্যা তারকার উপরে রয়েছে, অথচ বাস্তবতা হল, তার অবস্থান পাতালের তলদেশে। উদাহরণস্বরুপ, এরা সেহাহ্ সেত্তা থেকে কোন একটি হাদীসের কিতাব পড়ে এবং সেখানে কোথাও যদি তারা ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর মাযহাবের বিপরীত কোন হাদীস পায়, তবে তারা বলে, “আবু হানিফার মাযহাব দেওয়ালে ছুঁড়ে মার, আর রাসূলের হাদীস গ্রহণ করো। অথচ হাদিসটির বিধান রহিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, অথবা উক্ত হাদীসের চেয়ে শক্তিশালী বর্ণনার অন্য কোন হাদীস রয়েছে, অথবা এজাতীয় সুনিশ্চিত কারণ রয়েছে, যার কারণে হাদীসটির আমল পরিত্যাগ করা হয়েছে। অথচ সে এর কোনটিই জানে না। এ শ্রেণীর লোকদের হাতে যদি সাধারণভাবে হাদীস অনুসরণের দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন তারা নিজেরাও যেমন পথভ্রষ্ট হবে, তেমনি তাদের নিকট যারা প্রশ্ন করে, তাদেরকেও পথচ্যুত করবে”
ডাক্তার জাকির নায়েক যে দাবী করেছেন, আমি শতভাগ হানাফী, শতভাগ মালেকী, শতভাগ শাফেয়ী, শতভাগ হাম্বলী এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কেননা তাঁর এ বক্তব্য মূলতঃ ইমামদের বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে মাযহাব সমূহকে খেল-তামাশার বস্তু বানানরই নামান্তর। কারণ আমরা সকলেই জানি যে, একই সাথে চারও মাযহাব অনুসরণ কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
ডাঃ জাকির নায়েকের এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, একমাত্র তিনিই হয়ত সহীহ হাদীস মানতে আগ্রহী। ইমামগণ কি সহীহ হাদীস মানতেন না? কিংবা তাদের অনুসারী কেউ কি সহীহ হাদীস মানে না?
বিষয়টি এমন যেন চৌদ্দশ’ বছর যাবৎ মুসলিম উম্মাহ সহীহ হাদীস সম্পর্কে অবগত ছিল না, চৌদ্দশ’ বছর পরে ডাক্তার জাকির নায়েক কিংবা অপরাপর আহলে হাদীসগণ শুধু সহীহ হাদীস পড়ছেন। চৌদ্দশ’ বছরের কেউ হয়ত বোখারী পড়েননি, একমাত্র এরাই চৌদ্দশ’ বছর পরে এসে বোখারী পড়ছে। যুগশ্রেষ্ঠ উলামায়ে কেরাম যারা মাযহাবের অনুসারী ছিলেন, তারা সকলেই সত্তর ভাগ মাযহাবী ছিলেন, তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ত্ব যিনি একশ’ ভাগ মাযহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন; তাও আবার একই সাথে চার মাযহাবের একশ’ ভাগ অনুসারী।
বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ হয়ত সহীহ জানতেন না বা সহীহ হাদীস মানতেন না, এজন্য ডাঃ জাকির নায়েকের দৃষ্টিতে তারা হলেন, সত্তর ভাগ বা আশি ভাগ মাযহাবী। আমরা সকলেই জানি, বিখ্যাত মুহাদ্দিস, মুফাসসির, উসুলবিদ, দঐতিহাসিক প্রায় সকলেই দীর্ঘ বার-তের শ’ বছর যাবৎ কোন একটা মাযহাব অনুসরণ করেছেন। ডাঃ জাকির নায়েকের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা সকলেই সত্তরভাগ সহীহ হাদীস মানতেন, ইসলামের দীর্ঘ চৌদ্দশ’ বছর পরে, ডাঃ জাকির নায়েক দাবী করলেন যে, তিনি একশ’ ভাগ সহীহ হাদীস মানেন!
এসম্পর্কে আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেছেন-ولا تكن حاكما علي جميع فرق المؤمنين، كأنك قد أوتيت علما لم يؤتوه أو وصلت إلي مقام لم يصلوه.“মুমিনদের সকল বিষয়ে তুমি বিচারক সেজো না! তোমার ভাবখানা এমন যে, তুমি এমন ইলমের অধিকারী হয়েছো, যা পূর্ববর্তী কেউ অর্জন করেনি, তোমার কাছে এমন এলম পেীঁছেছে, যা পূর্ববর্তীদের কাছে পেীঁছেনি।”
যারা ইমামদের এসমস্ত কথার অপব্যাবহার করেন, তাদের জন্য আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর নি¤েœাক্ত উক্তিটি মনে রাখা দরকার-ومن ظن بأبى حنيفة أو غيره من أئمة المسلمين أنهم يتعمدون مخالفة الحديث الصحيح لقياس أو غيره فقد أخطأ عليهم، وتكلم إما بظن وإما بهوى
অর্থাৎ “যে ব্যক্তি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) অথবা মুসলমানদের অন্য কোন ইমামদের ব্যাপারে এই ধারণা পোষণ করে যে, তারা ক্বিয়াস কিংবা অন্য কোন কারণে সহীহ হাদীস ছেড়ে দিয়েছেন, তবে সে তাদের উপর ভ্রান্ত বিষয় আরোপ করল এবং নিজের ধারণা অথবা প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে তাদের উপর মিথ্যারোপ করল” [মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড-২০, পৃষ্ঠা-৩০৪]
সার কথা হল, প্রত্যেক ইমাম যে বলেছেন, “হাদীস সহীহ হলে সেটিই আমার মাযহাব” এর অর্থ হল, হাদীসটি আমল যোগ্য হতে হবে। কেননা হাদীস সহীহ হলেই সেটি আমল যোগ্য হয় না। এ বিষয়ে সমস্ত মুহাদ্দিস, সমস্ত মুফাসসির, সমস্ত ফকীহ একমত যে, সকল সহীহ হাদীস আমল যোগ্য নয়। এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) লিখেছেন,أما الأئمة و فقهاء أهل الحديث فإنهم يتبعون الحديث الصحيح حيث إذا كان معمولا به عند الصحابة و من بعدهم أو عند طائفة منهم فأما ما اتفق علي تركه فلا يجوز العمل به لأنهم ما تركوه علي علم أنه لا يعمل به
“ইমামগণ এবং হাদীস বিশারদ ফকীহগণ কোন একটি হাদীস সহীহ হলে, তার উপর তখনই আমল করেন, যখন কোন সাহাবী, তাবেয়ী, অথবা তাদের নির্দিষ্ট কোন একটি দল থেকে হাদীসটির উপর আমলের প্রমাণ পাওয়া যায়। আর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) যে হাদীসের উপর আমল না করার ব্যাপারে একমত হয়েছেন, তার উপর আমল করা জায়েয নেই; কেননা তার উপর যে আমল করা যাবে না, সেটা জেনেই তারা হাদীসটি পরিত্যাগ করেছেন।” এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা হল, ইমামগণের এ সমস্ত বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে মানুষের মাঝে মাযহাবের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো নিতান্তই দুঃখজনক। প্রত্যেক ইমাম যে বলেছেন, ‘হাদীস সহীহ হলে সেটি আমার মাযহাব’ তাদের এ বক্তব্যের দ্বারা উদ্দেশ্য হল, إذا صلح الحديث للعمل به فهو مذهبي“অর্থাৎ “হাদীসটি যখন আমল যোগ্য হবে, তখন সেটি আমার মাযহাব হবে”
কিন্তু বর্তমানে আহলে হাদীস বা সালাফীরা এ সমস্ত বক্তব্য উল্লেখ করে, মানুষের মাঝে মাযহাবের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। মাযহাবের বক্তব্যের বিরোধী কোন হাদীস পেলে, সেসম্পর্কে কোন ইলম হাসিল না করেই, মাযহাব এবং মাযহাবের ইমামদের সম্পর্কে বিষোদগার শুরু কওে; অথচ বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যাবে, উক্ত হাদীস পরিত্যাগের যথাযোগ্য কারণ রয়েছে।
বর্তমানে যারা সহীহ হাদীস অনুসরণের নামে নতুন নতুন মাযহাবের অবতারণার চেষ্টা করছে, তাদের অধিকাংশ মাসআলা এমন যে, তা পরিত্যাগ করার ব্যাপারে দীর্ঘ চৌদ্দশ’ বছরের মুসলিম উম্মাহ একমত। যেমন, এরা বলে বীর্য পাক, এদের অনেকে বলে তা খাওয়া বৈধ, গান-বাদ্য জায়েয, জুমুআর খুতবা যে কোন ভাষায় দেয়া জায়েয, কাযা নামায বলতে কিছু নেই, অর্থ না বুঝে কুরআন পড়লে কোন সওয়াব হবে না, তারাবী বিশ রাকাত নয়, আট রাকাত ইত্যাদি।
কুরআন অনুসরণ করতে গিয়ে যেমন মদকে হালাল করা যাবে না, তেমনি সহীহ হাদীসের অনুসরণের কথা বলে রহিত হাদীস দিয়ে গান-বাদ্য, বেপর্দা ইত্যাদিকে জায়েয বলা যাবে না। এগুলো মূলতঃ সহীহ হাদীসের অনুসরণ নয়, হাদীস অনুসরণের ছদ্মাবরণে ইসলামকে বিকৃত করার অপচেষ্টা।
“হাদীস সহীহ হলে সেটিই আমার মাযহাব” এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের বক্তব্যঃ
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লাামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেছেন,ووجه النظر أن محل العمل بهذه الوصية ما إذا عرف أن الحديث لم يطلع عليه الشافعي أما إذا عرف أنه أطلع عليه و رده أو تأوله بوجه من الوجوه فلا “ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এর উক্ত বক্তব্যের তখনই আমল করা যাবে, যখন এ ব্যাপারে সুনিশ্চিতভাবে অবগত হওয়া সম্ভব হবে যে, তিনি হাদীসটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। কিন্তু যদি প্রমাণিত হয় যে, তিনি হাদীসটি সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন এবং তিনি হাদীসটির উপর আমল করেন নি কিংবা হাদীসটির কোন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তবে সেক্ষেত্রে উক্ত বক্তব্যের আমল করা যাবে না।”
১. আল্লামা ইবনে হামদান (রহঃ) লিখেছেন,و ليس لكل فقيه أن يعمل بما رآه حجة من الحديث حتي ينظر هل له معارض أو ناسخ أم لا أو يسأل من يعرف ذلك و يعرف به، و قد ترك الشافعي العمل بالحديث عمدا لأنه عنده منسوخ لما بينه
“প্রত্যেক ফকীহের জন্য এই অনুমতি নেয় যে, বাহ্যিক হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে তার উপর আমল করবে, যতক্ষণ না সে এ বিষয়ে সুনিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করবে যে, এ হাদীসটির সাংঘর্ষিক কোন দলিল আছে কি না, অথবা হাদিসটির বিধান রহিত কি না। এ ব্যাপারে সে যদি জ্ঞান না রাখে, তবে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) অনেক হাদীসের উপর ইচ্ছা করেই আমল করেননি, কেননা তাঁর নিকট সে সমস্ত হাদীসের বিধান রহিত ছিল (মানসুখ)।”
قال النووي في " شرح المهذب " ( ১/১০৪ ) : هذا الذي قاله الشافعي ليس معناه أن كل أحد رأى حديثا صحيحا قال : هذا مذهب الشافعي وعمل بظاهره ، وإنما هذا فيمن له رتبة الإجتهاد في المذهب ، وشرطه أن يغلب على ظنه أن الشافعي رحمه الله لم يقف على هذا الحديث أو لم يعلم صحته ، وهذا إنما يكون بعد مطالعة كتب الشافعي كلها ونحوه من كتب أصحابه الآخذين عنه ، وماأشبهها ، وهذا شرط صعب قل من يتصف به ، وإنما اشترطوا ماذكرنا لأن الشافعي رحمه الله ترك العمل بظاهر أحاديث كثيرة رآها وعلمها لكن قام الدليل عنده على طعن فيها أو نسخها أو تخصيصها أو تأويلها أو نحو ذلك ، قال الشيخ أبو عمرو - هو الإمام ابن الصلاح - : ليس العمل بظاهر ماقاله الشافعي بالهين ، فليس كل فقيه يسوغ له أن يستقل بالعمل بما يراه حجة من الحديث . أهـ
ইমাম নববী (রহঃ) “শরহুল মুহাজ্জাব”এ লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) যে বলেছেন “হাদীস সহীহ হলে সেটিই আমার মাযহাব” এর অর্থ এই নয় যে, যে কেউ সহীহ হাদীস দেখলেই বলবে যে, এটি ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এর মাযহাব এবং বাহ্যিক হাদীসের উপর আমল করবে। বরং এটিই তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, যে মুজতাহিদ ফিল মাযহাব। এর জন্য শর্ত হল, তার প্রবল ধারণা হতে হবে যে, শাফেয়ী (রহঃ) এই হাদীস সম্পর্কে অবগত হননি অথবা ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) হাদীসটি সহীহ হওয়ার ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। আর এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এর সকল কিতাব অধ্যয়ন করা হবে এবং তাঁর নিকট থেকে যারা ইলম শিক্ষা করেছে, তাদের সব কিতাব মুতায়ালা করতে হবে। এটি একটি কঠিন শর্ত, যা অল্প সংখ্যক লোকই অর্জন করতে পারে। ফকীহগণ পূর্বোক্ত শর্তগুলো একারণে আরোপ করেছেন যে, কোন একটি হাদীস ত্র“টিযুক্ত, রহিত, সুনির্দিষ্ট অথবা হাদীসটির ব্যাখ্যা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ার কারনে ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) অনেক সহীহ হাদীসের উপর আমল করেননি অথচ তিনি এ সমস্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং অন্যদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। এবং এর জন্য ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এর নিকট সুনির্দিষ্ট দলিল ছিল। শায়খ আবু আমর ইবনুস সালাহ বলেন, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) যা বলেছেন, তার বাহ্যিকের উপর আমল করাটা সহজ নয়। কেননা প্রত্যেক ফকীহ হাদীসকে হুজ্জত হিসেবে গ্রহণ করে তার উপর আমল করতে পারবে না”
মূলতঃ রাসূলের হাদীস বর্ণনার দিক থেকে সহীহ হলেই সেটি আমল যোগ্য নয়। সমস্ত আলেম এ ব্যাপারে একমত যে, হাদীস সহীহ হলেই সেটি আমলযোগ্য নয়। বরং এক্ষেত্রে দেখতে হবে, এ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক অন্য কোন হাদীস বা কুরআনের কোন নির্দেশনা আছে কি না। হাদীসটির বিধান রহিত কি না, ইত্যাদি। একজন সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, বড় বড় আলেমদের পক্ষেও এ বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা কঠিন। যারা ইজতেহাদের যোগ্যতা রাখেন, তারাই কেবল এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
শরীয়তের বিষয়ে যারা কোন জ্ঞান রাখে না, অথবা জ্ঞান থাকলেও যেটা ইজতেহাদের জন্য যথেষ্ঠ নয়, তারা সহীহ হাদীস পেলেই সেটা নিয়ে খুব মাতামাতি করে। অনেকে হয়ত এতটুকু জানে না, সহীহ হাদীস কাকে বলে, কখন সহীহ হাদীসের উপর আমল করা যায় এবং কখন সহীহ হাদীসের উপর আমল করা যায় না।
এ প্রসঙ্গে শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ একটি ঘটনা র্বণনা করেছেনÑ শায়খ আব্দুল গাফফার (রহঃ) “দাফউল আওহাম আন মাসআলাতিল কিরাতি খালফাল ইমাম” নামক একটি কিতাব রচনা করেন। এ কিতাব রচনার মূল কারণ ছিল, শামের তরাবুলুস শহরের এক লোক হোম্স শহরে আসে এবং শায়খকে বলে যে, আমাদের ওখানে একজন লোক রয়েছে, যার বক্তব্য হল, যে ব্যক্তি নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ে না, সে কাফের।
তাকে কারণ জিজ্ঞেস করা হলে সে তার কথার যুক্তি দেখাল যে, রাসূল (সঃ) বলেছেন, সূরা ফাতিহা ব্যতীত নামায হয় না, আর যার নামায সহীহ হল না, সে কেমন যেন নামায পড়ল না। আর যে নামায পড়ল না, সে কাফের”
তখন শায়খ আব্দুল গাফফার (রহঃ) এক বৈঠকে, দু’ঘন্টার মাঝে উক্ত কিতাব রচনা করে তরাবুলুস শহরের ঐ লোককে দিয়ে দিলেন।”
এজন্যই হয়ত ইমাম মালেক (রহঃ) এবং ইমাম লায়স বিন সা‘য়াদ (রহঃ) এর ছাত্র, আবু মুহাম্মাদ আব্দল্লাহ বিন ওহাব (রহঃ) বলেছেন,الحديث مضلة إلا للعلماء “আলেমগণ ব্যতীত অন্যদের জন্য হাদীস হল ভ্রান্তির কারণ”
ইমাম আবু যায়েদ কাইরাওয়ানী (রহঃ) লিখেছেন,قال الإمام إبن أبي زيد القيرواني رحمه الله: ( قال إبن عيينة: الحديث مضلة إلا للفقهاء) يريد: أن غيرهم قد يحمل شيئا علي ظاهره و له تأويل من حديث غيره، أو دليل يخفي عليه، أو متروك أوجب تركه غير شيء، مما لا يقوم به إلا من استبحر و تفقه)
“আল্লামা ইবনে উয়াইনা (রহঃ) বলেছেন, ফকীহগণ ব্যতীত অন্যদের জন্য হাদীস হল, ভ্রান্তির কারণ। এর দ্বারা তিনি উদ্দেশ্য নিয়েছেন, ফকীহগণ ব্যতীত অন্যরা হয়ত হাদীসকে তার বাহ্যিক অর্থের উপর প্রয়োগ করবে, অথচ অন্য কোন হাদীস দ্বারা এর ভিন্ন কোন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অথবা অন্যদের নিকট হাদীসের দলিল অস্পষ্ট থাকবে, অথবা হাদীসটি মূলতঃ আমলযোগ্য নয়, যার সুস্পষ্ট কোন কারণ রয়েছে, যা এ বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী এবং ফকীহগণ ব্যতীত অন্যরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না”
আমাদের সমাজে দেখা যায়, শরীয়তের বিষয়ে যাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা কোন এক ইমামের এধরণের উক্তি মুখস্থ করে নিজেও যেমন ধোঁকায় পড়ে এবং অন্যকেও ধোঁকায় ফেলে। একথা বললে, অনেকেই হয়ত বলবেন, নবীজীর হাদীসের উপর একজন আমল করছে আর তার ব্যাপারে ভ্রান্ত হওয়ার ফয়সালা দেয়া হবে?
এ প্রসঙ্গে শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ লিখেছেন,و هنا تثور ثائرة أدعياء الدعوة إلي العمل فيقولون: هل يجوز لكم أن تحمكموا بالضلال علي من يعمل بالسنة و يفتي الناس بها؟!فنقول : نعم إذا لم يكن أهلا لهذا المقام، فحكمنا عليه بالضلال لا لعمله بالسنة، معاذ الله بل لتجرئه علي ما ليس أهلا له
“আমাদের সমাজে কিছু দায়ী রয়েছে, যারা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করবেন, আপনারা এমন ব্যক্তিকে ভ্রান্ত হওয়ার কথা বলছেন, যে রাসূলের সুন্নাহের উপর আমল করার নির্দেশ দিচ্ছে এবং সুন্নাহের আলোকে মানুষকে ফতোয়া দিচ্ছে?
আমরা বলব, যেহেতু সে এ কাজের যোগ্য নয়, এজন্য তাকে আমরা তার ভ্রান্তির ব্যাপারে ফয়সালা দিচ্ছি, সে সুন্নাহের উপর আমল করছে এ কারণে নয়। বরং সে যে বিষয়ের যোগ্য নয়, সে বিষয়ে ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের জন্য।”
No comments:
Post a Comment