Thursday, January 26, 2017

সমাজের প্রচলিত নামাজের ভুল ৬১-৬৫





৬১। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে মাযাহাবের দুহাই দিয়ে মুষ্ঠীমেয় মাসজিদ ছাড়া সব মাসজিদগুলোতে আউয়অল ওয়াক্তে সলাত পড়া হয়না বরং মধ্যম থেকে আখেরী ওয়াক্তে পড়া হয়। বিশেষ করে ফযর, আসর ও জোহর ওয়াক্ত সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে অনেক কর্মব্যস্ত মহিলারা ও পুরুষেরা জোহরের সলাত আসরের সময় আদায় করে থাকে।
.
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতিঃ সলাতের সময়ের গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ‘‘নিশ্চয়ই মু‘মিনদের উপরে নির্দিষ্ট সময়ে সলাত আদায় করা ফরয করে দেওয়া হয়েছে। (সূরা-নিসা-১০৩) মি‘রাজ রজনীতে সলাত ফরয হওয়ার পরের দিন (নায়নুল আওত্ত্বার ২/২৮) জোহরের সময় জিবরীল (আঃ) এসে প্রথম দিন আউয়াল ওয়াক্তে পরের দিন শেষ ওয়াক্তে নিজ ইমামতিতে পবিত্র কা’বা চত্বরে মাকামে ইব্রাহীমের পাশে দাঁড়িয়ে পাঁচ পাঁচ দশ ওয়াক্ত সলাত আদায় করে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) কে সলাতের পছন্দনীয় সময়কাল ঐ দুই সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। (সহীহ্ আবু দাউদ-হা/৪১৬, মিশকাত, সলাতের সময়কাল অধ্যায়-হা/৫৩৮)---- রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞাসা করা হ‘লো যে, কোন কাজটি অধিক উত্তম? তিনি বললেনঃ ‘‘ প্রথম ওয়াক্তে সলাত আদায় করা (সহীহ্ আবু দাউদ-১/৬১ পৃঃ, তাহকীক মিশকাত ১/১৯২ পৃঃ টিকা-৭) হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ‘‘ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) তাঁর জীবনে মাত্র দু’বার ছাড়া কখনও সলাত শেষ ওয়াক্তে পড়েননি।’’ (সহীহ্ তিরমিযী, মিশকাত ৬১ পৃঃ) এজন্য তিনি আলী (রাঃ) লক্ষ্য করে বলেনঃ ‘‘হে আলী ৩টি কাজে মোটেই দেরী করবেনা তন্মধ্যে ১টি হলো যখনই সলাতের সময় হবে তখনই সলাত আদায় করো’’। (সহীহ্ তিমমিযী, মিশকাত ৬১ পৃঃ) 
.

নিন্মে সলাতের ওয়াক্তসমূহ সংক্ষেপে দেওয়া হলো
১। ফজরঃ- সুবহে সাদিক হতে সূর্যদ্বয়ের পূর্ব পর্যন্ত। রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) সর্বদা ‘গলস’ অর্থাৎ একটু অন্ধকার থাকতে ফজরের সলাত আদায় করতেন। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, মিশকাত-৬০ পৃঃ) হানাফী মাযহাবের মুহাক্কেক ইমাম তাহাবী (রহঃ) বলেনঃ ‘‘ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণিত, সুন্নাহ অনুযায়ী ‘গালাসে’ অর্থাৎ অন্ধকারে ফজরের সলাত শুরু করা উচিৎ এরবং ‘ইস্ফার’ (একটু ফর্সা) হলে শেষ করা উচিৎ এটাই হ’ল ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রাহেমাহুমুল্লাহ) প্রমুখের মত। (সরহে মাআনীল আছার-১/৯০ পৃঃ)
২। যোহরঃ- সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিমে ঢলে যাওয়ার পর হতে শুরু করে প্রতিটি বস্ত্তর ছায়া সমপরিমাণ হওয়া পর্যন্ত যোহরের সময় থাকে। (সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, মিশকাত-৫৯ পৃঃ) উল্লেখ্য যে, ইমাম আবু হানীফার শাগরেদদ্বয় অর্থাৎ আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ এবং খোদ ইমাম আবু হানীফার (রহঃ) একটি মত উপরে উল্লিখিত সহীহ্ হাদীসের উক্ত সময়কালকে সমার্থণ করেছেন। (হেদায়া-১/৮১ পৃঃ ‘সলাত’ অধ্যায় ‘সময়’ অনুচ্ছেদ)
৩। আসরঃ- প্রতিটি বস্ত্তর ছায়া সমপরিমাণ হওয়া থেকে সূর্য হলুদ বর্ণ হওয়া পর্যন্ত আসরের সময়। (সহীহ্ মুসলিম, মিশকাত বাংলা-হা/ ৫৩৪) তবে বিশেষ কোন ওজরবসত সূর্যাস্তের পূর্বে এক রাক‘আত আদায় করলে তা সময়ের মধ্যে গণ্য হবে। (সহীহ্ বুখারী, সহীহ্ মুসলিম, মিশকাত-৩৬১ পৃঃ) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর একমত এবং তাঁর দু’ছাত্র আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদের নিকট প্রতিটি বস্ত্তর ছায়া সমপরিমাণ হলে আসর শুরু হয়। (হিদায়া মাআ দিরায়া-১/৮১ পৃঃ)
৪। মাগরিবঃ- সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে পশ্চিম আকাশে লাল আভা দুর না হওয়া পর্যন্ত মাগরিব সলাতের সময়। (সহীহ্ মুসলিম, মিশকাত-৫৯ পৃঃ) তবে আউয়াল ওয়াক্তে অর্থাৎ সূর্যাস্তের সাথে সাথে সলাতুল মাগরিব আদায় করা রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীগণের সুন্নাত।
৫। ঈশার সলাতের সময়ঃ পশ্চিম আকাশে লাল আভা দূর হওয়ার পর থেকে অর্ধেক রাত পর্যন্ত ঈশার সলাতের সময়। (সহীহ্ মুসলিম, মিশকাত-৫৯ পৃঃ) তবে রাত্রের এক তৃতীয়াংশের সময় পড়া উত্তম। (আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্, মিশকাত-৬১ পৃঃ) উল্লেখ্য যে, যরুরী কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত ঈশার সলাত পড়া জায়েজ আছে। (সহীহ্ মুসলিম, ফিকহুস সুন্নাহ্-১/৭৯ পৃঃ)
.

৬২। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে অনেক অসুস্থ্য ব্যক্তি অর্থাৎ সাজদাহ্ করতে অপারগ ব্যক্তিকে বালিশে, অথবা টেবিলে, আজাকালতো মাসজিদগুলোতে এক ধরণের সামনে টেবিল বিশিষ্ট চেয়ার এর উপর সলাতে সাজদাহ্ করতে দেখা যায়। অথচ এভাবে অসুস্থ্য ব্যক্তিকে কোন জিনিষের উপর সাজদাহ্ করতে কঠোরভাবে নিষেধ আছে।
.

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতিঃ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) পীড়িত ব্যক্তিকে পরিদর্শন করতে গিয়ে তাকে বালিশের উপর সলাত আদায় করতে দেখে তিনি তা টেনে নিয়ে দূরে নিক্ষেপ করেন। অতঃপর সে ব্যক্তি একখন্ড কাঠ নিলেন এর উপর সলাত পড়ার জন্য। তিনি তাও টেনে নিয়ে ফেলে দিলেন এবং বললেনঃ ‘‘যদি সম্ভব হয় তাহলে মাটির উপর সলাত পড়বে তানা হলে ইশারা করে পড়বে, এবং সাজদাহ্কে রুকূ অপেক্ষা বেশি নিচু করবে’’। (সহীহ্ বুখারী, তাবরানী, কাযযার, ইবনুস সান্মাক, সহীহ্ হাদীস গ্রন্থে)
.

৬৩। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের দেশে সাহ্ও সাজদাহ্র যে নিয়ম প্রচলণ আছে তা সুন্নাত বিরোধী। ‘‘সলাতে ভুল হলে সলাতের ভিতরে শেষ বৈঠকে শুধুমাত্র ‘তাশাহুদ’ পাঠ করিয়া ডান দিকে সালাম ফিরাইয়া দুইটি সাজদাহ্ করিতে হয়। অতঃপর বসিয়া আত্তাহিয়্যাতু, দরূদ ও দোয়া পড়িয়া সালাম ফিরাইয়া সলাত শেষ করিতে হয়। (মোকছুদুল মোমেনীন-১৮৭ পৃঃ)
.

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতিঃ যদি ইমাম সলাতরত অবস্থায় নিজের ভুল সম্পর্কে নিশ্চিত হন কিংবা লোকমা দিয়ে মুক্তাদিগণ ভুল ধরিয়ে দেন, তবে তাশাহুদ শেষে তাকবীর দিয়ে পর পর দু’টি ‘সাজদায়ে সহো’ দিবেন। অতঃপর সালাম ফিরাবেন। (মুত্তাফাক্ব আলাই, মিশকাত-হা/ ১০৮ ‘সলাত’ অধ্যায় ‘সাহো’ অনুচ্ছেদ)। সলাতে (রাক‘আতে) কমবেশী যা-ই হৌক সালামের আগে বা পরে দু’টি ‘সাজদায়ে সহো’ দিতে হবে। (সহীহ্ মুসলিম নায়লুল আওত্তার-৩/৪১১)। সার কথা ‘সাজদায়ে সহো’ সালাম ফিরানোর পূর্বে ও পরে উভয় জায়েয আছে। তবে কেবল ডাইনে একটি সালাম দিয়ে ‘সাজদায়ে সহো’ করার প্রচলিত প্রথার কোন ভিত্তি নেই। (মিরাতুল মাকাতীহ-২/৩২-৩৩) অনুরূপভাবে ‘সাজদায়ে সহো’র পরে ‘তাশাহুদ’ পড়ার কোন সহীহ্ হাদীস নেই। উক্ত মর্মে ইমরান বিন হুসাঈন (রাঃ) হ’তে যে হাদীসটি এসেছে, তা দুর্বল। (তিরমিযী, আবু দাউদ, ইরওয়াউল গালীল হা/ ৪০৩, ২//১২৮-২৯ পৃঃ) হানাফী মাযহাবের প্রমাণ্য গ্রন্থ হেদায়ার ব্যাখ্যাকার ইবনুল হুমাম আল-হানাফী (রহঃ) বলেনঃ ‘‘ এক দিকে সালাম ফিরানোকে বিদ‘আত বলা হয়েছে।’’ (ফতহুল কাদীর ১/২২২ পৃঃ) অনুরূপভাবে সহো সাজদাহর পর ‘তাশাহুদ’ পড়া সম্পর্কে আল্লামা যাইলায়ী-আল-হানাফী (রহঃ) বলেনঃ ‘‘ ‘সহো সাজদাহর’ পর তাশাহুদ পড়ার প্রমাণে কোন সহীহ্ হাদীস নেই। (নাসুবুররায়াহ, আইনী-তুহফা-১/২১৯ পৃঃ)
.

৬৪। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে প্রায় সকল মাসজিদে ও ঘরে কারুকার্যখচিত মুসাল্লাহ ও অনুরূপ কাপড়ে মুসল্লীদের সলাত আদায় করতে দেখা যায়। অনুরূপ মাসজিদগুলোতে সামনের দেওয়ালে, মক্কা-মদিনার মিনারসহ বিভিন্ন ধরণের নকশাদার টাইল্স বসানো হচ্ছে যা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এর নিদের্শ বিরোধী। অনুরূপ যার দ্বারা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এর সলাতে অমনোযোগী হওয়ার কারণ হয়েছিল। তাহলে আমাদের বর্তমান ইমাম ও মুসল্লীদের অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
.

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘‘ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) একদা একটি কারুকার্যখচিত চাদর গায়ে দিয়ে সলাত আদায় করলেন। আর সলাতে সে চাদরের কারুকার্যের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ল। সলাত শেষে তিনি বললেনঃ ‘‘ এ চাদরখানা আবু জাহামের নিকট নিয়ে যাও আর তার কাছ থেকে কারুকার্য ছাড়া মোটা চাদর নিয়ে আস। এটা আমাকে সলাত হতে অমনোযোগী করে দিচ্ছিল’’। হিসাম ইবনু উরওযাহ (রহঃ) তাঁর পিতা হতে এবং তিনি আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘‘ আমি সলাত আদায়ের সময় এর কারুকার্যের প্রতি আমার দৃষ্টি পড়ে তখন আমি আশংকা করছিলাম যে, এটা আমাকে ফিতনায় ফেলে দিতে পারে।’’ (সহীহ্ বুখারী-তাওঃ হা/৩৭৩ পৃঃ , ১৯৫ সহীহ্ মুসলিম-হা/ ১১২৮ পৃঃ ৩২৯) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, আয়িশা (রাঃ) এর নিকট একটি বিচিত্র রঙ্গের পাতলা পর্দার কাপড় ছিল। তিনি তা ঘরের এক দিকে পর্দা হিসাবে ব্যবহার করছিলেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)- বললেনঃ ‘‘ আমার সামনে থেকে তোমার এই পর্দা সরিয়ে নাও। কারণ সলাত আদায় করার সময় এর ছবিগুলো আমার সামনে ভেসে ওঠে। (সহীহ্ বুখারী-১৯৫ পৃঃ হা/ ৩৭৪)
.
৬৫। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের দেশে অধিকাংশ মুসল্লীদের দেখা যায় স্থান পরিবর্তণ না করে ফরয ও সুন্নাত এই স্থানে আদয় করে থাকে। অথচ তা সুন্নাহ বিরোধী। বরং দুই সলাতের মধ্যে পার্থক্য করা উচিত।

.
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতিঃ মুআবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ‘‘নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন এক সলাতের সাথে অন্য সলাতকে মিলিয়ে না দেই যতক্ষণ পর্যন্ত কথা না বলি বা বের না হয়ে যাই। (সহীহ্ মুসলিম, ফা.আরকানুল ইসলাম-২১/২৮৮ পৃঃ ৩৯১) এজন্য বিদ্বানগণ বলেন, ফরয এবং সুন্নাতের মধ্যবর্তী সময়ে কথা বলে বা স্থানান্তর হয়ে পার্থক্য করা উচিৎ।

...............................................................
বইটির নামঃ'' প্রচলিত ভুল বনাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সলাত আদায়ের পদ্ধতি।''এই গ্রন্থে নামাজের ১০১ টির অধিক ভুলের দলিলসহ সমাধান পেশ করা হয়েছে।
লেখকঃ সাইখ মুরাদ বিন আমজাদ

No comments:

Post a Comment