৫৬। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে, বিশেষ করে আহলে হাদীসগণের মধ্যে যার জানাযা হয়েছে এমন ব্যক্তির জন্য একাধিক স্থানে গায়েবানা জানাযা পড়া হয়ে থাকে, অথচ এর শরয়ী কোন ভিত্তি নেই।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর জানাযার সলাত চার তাকবীরে পড়েছেন (সহীহ্ বুখারী)। অন্য বর্ণনায় হুযাইফা বিন উসাইদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসে বললেনঃ ‘‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের প্রতি জানাযার সলাত পড়। যে ভাই তোমাদের অন্য দেশে মৃত্যুবরণ করেছে। সাহাবাগণ বলেন, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) তিনি কে? নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) বললেন, আবিসিনিয়ার বাদশাহ সুমো নাজ্জাশী। সাহাবাগণ দাঁড়ালেন এবং তার গায়েবী জানাযার সলাত পড়লেন। (মুসনাদে তাহমাদ, ফতহুর রববানী-৭/২২০ পৃঃ, ইবনু মাজাহ-১/১১০, ১১১ পৃঃ, সহীহ্ মুসলিম-হা/ ২০৭১-২০৭৭ ই.ফা.বা) এজন্য বিদ্বানদের প্রাধান্যযোগ্য মত হচ্ছে গায়েবানা জানাযা শরীআতসম্মত নয়। তবে যে ব্যক্তির জানাযা হয়নি তার গায়েবানা জানাযা পড়া যাবে। যেমন জনৈক মুসলমান কোন কাফির ভূখন্ডে মৃত্যুবরণ করল অথবা পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করল কিন্তু তার লাশ পাওয়া গেলনা। তখন তার গায়েবানা জানাযা আদায় করা ওয়াজিব। অন্যথায় নয়। (বিস্তারিত দেখুন-নাসির উদ্দিন আল-আলবানীর সলাতুল জানাযা ও শইখ উসাইমীন-এর ফাতওয়া আরবানুল ইসলাম-৪৪০ পৃঃ)
.
৫৭। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে দুই ঈদ ৬ তাকবীরের সাথে আদায় করা হয়ে থাকে। দলীল হিসেবে বলা হয়-‘‘প্রথম রাকআতে তাকবীরে তাহরীমা বলিয়া হাত বাঁধিবেন। তারপর তিনবার তাকবীর বলিবেন। অতঃপর সূরায়ে ফাতিহা ও তার সাথে অন্য একটি সূরা পড়িবেন। তারপর তাকবীর বলিয়া রুকূতে যাইবেন। অতঃপর দ্বিতীয় রাক‘আতে প্রথম ক্বিরআত পড়িবেন। ক্বিরআত শেষে তিনবার তাকবীর বলিবেন ও চতুর্থ তাকবীর বলিয়া রুকূতে যাইবেন। (কুদুরী-৯৪ পৃঃ) ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনুদিত হিদায়াতেও অনুরূপ বলা হয়েছে। অতঃপর শেষে বলা হয়েছে এই হল ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর মত এবং তা আমাদের মাযহাব। (হিদায়া-১/১৬২ পৃঃ)।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ আবুদল্লাহ ইবিন আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি দু’ ঈদের সলাত প্রথম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত সাত তাকবীর দিয়েছেন এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে দাঁড়ানো তাকবীর ব্যতীত পাঁচ তাকবীর দিয়েছেন। এই সনদ সহীহ্ এবং বর্ণনাকারীগণ অধিক নির্ভরযোগ্য এবং অধিকতর প্রতিষ্ঠিত শব্দে বর্ণিত কেননা এ হাদীস ‘সামীতু’ বা ‘আমি নিজে শুনেছি’- এরকম শব্দ দ্বারা এসেছে। (ইমাম শাফেয়ীর কিতাবুল উলম-১/২৩৬ পৃঃ, আবু দাউদ-১৬৩ পৃঃ, তিরমিযী-১/৭০ পৃঃ, ইবনে মাজাহ্-৯১ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, হাদীসের গ্রন্থসমূহের মধ্যে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও নাসাঈ এই তিনটি গ্রন্থে ঈদের সলাতের তাকবীর সম্পর্কে কোন হাদীস নেই। এছাড়া বাকী সব গ্রন্থে ঈদের সলাতের তাকবীর সম্পর্কে ২০০ টির অধিক হাদীস রয়েছে, কিন্তু ‘ছিত্তাতুন’ বা ৬ শব্দ বলে কোন সহী্হ্ তো দূরের কথা কোন দুর্বল এমনকি মাওযু হাদীসও নেই। অতএব সকল প্রকার ভ্রান্ত দলীল ও মাযহাবী গোঁড়ামী বর্জন করে হাদীসের উপর আমল করার উদাত্ত আহবান রইল।
ফুটনোটঃতবে কেউ যদি ৬ তকবীরে সালাত আদায় করে তার সালাত হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ কেননা কিছু আছার বর্ণিত আছে ৬ তাকবির সম্পর্কে যদিও ১২ তাকবীর হচ্ছে সহিহ হাদিস সম্মত। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে প্রচুর বাড়াবাড়ি দেখা যায় যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। কেননা শিরক কুফর আর বিদআত নির্মূল করার প্রচেষ্টা থেকে অনেক সময় আমরা এমন অনেক বিষয় নিয়েই বাড়াবাড়ি করি আর এই কারনে সমাজে ফিতনার সৃষ্টি হয়। - বাংলা হাদিস।
.
৫৮। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের দেশে মহিলাদের ঈদের সলাত থেকে বঞ্চিত রাখা। পর্দার অযুহাত দিয়ে। অথচ তাদেরকে ঈদের সলাতে অংশগ্রহণ করতে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দিয়েছেন। ভ্রান্ত ফতোয়ার দ্বারা তাদেরকে নেকী অর্জনের পথ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বরং নারীদেরকে পূর্ণ পর্দার সাথে ঈদের জামা‘আতে শরীক হবার সুযোগ করে দিতে হবে। ‘‘ মহিলাদের জন্য মসজিদ বা ঈদগাহে জামা‘আতে সলাত পড়তে যাওয়া মাকরূহ ও নিষিদ্ধ। সাহাবাদের যুগ থেকে এই নিষেধাজ্ঞা চলে আসছে।’’ (দররুল মুখতার এর উদ্বৃতিতে ফাতওয়ায়ে দরুল উলুম ৩য় খন্ড আহকামে জিন্দেগী-১৫৯)
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ উম্মে আতিয়াহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘‘ আমাদের নারীদেরকে আদেশ করা হয়েছে যে, আমাদের ঋতুবতী মহিলাগণ ও পর্দানশীল মহিলাগণ যেন দুই ঈদের দিনেই ঈদগাহে বের হবে যাতে তারা মুসল্লীদের জামা‘আতে উপস্থিত হতে পারে এবং দু‘আয় অংশগ্রহণ করতে পারে। আর ঋতুবতী নারীরা তাদের সলাতের স্থান হতে একপাশে সরে বসে। তখন এক মহিলা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) আমাদের কারও কাছে শরীর ঢাকার মত চাদর নেই! রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) বললেন, তার বান্ধবীর আপন চাদর ধার হিসাবে পরবে। (সহীহ্ বুখারী-১৩৩ পৃঃ, সহীহ মুসলিম-২৮৯,২৯০ পৃঃ, আবু দাউদ-১৭৭ পৃঃ, তিরমিযী-১১৯ পৃঃ)
.
৫৯। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে উামার (রাঃ) এর দোহাই দিয়ে বিশ রাক‘আত তারাবীহ্র সলাত পড়া হয়। অথচ তা সম্পূর্ণ রাসূলের পদ্ধতির বিপরীত। আর উমার (রাঃ) ও আট রাক‘আত তারাবীহ্ চালু করেছেন।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ জননী আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘‘রমাযান ও রমাযান ব্যতীত অন্য সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এর রাতের সলাত ১১ (এগার) রাক‘আতের বেশী ছিল না। (সহীহ্ বুখারী, সহীহ্ মুসলিম) সায়ের বিন ইয়াযীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘‘ উমার (রাঃ) উবাই বিন কা’আব ও তামীম আদ্দারিকে রমাযান মাসে লোকদেরকে ১১ (এগার) রাক‘আত সলাত পড়াতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতঃপর ইমাম একশত আয়াতের অধিক আয়াত বিশিষ্ট সূরাসমূহ পড়তে থাকেন যাতে আমরা দীর্ঘ সময়ে দাঁড়ানোর কারণে লাঠিতে ভর দিতে বাধ্য হতাম। তখন আমরা ফজরের কাছাকাছি সময় ব্যতীত উক্ত নফল সলাত হতে অবসর গ্রহণ করতে পারতাম না। (সহীহ্ বুখারী-১/১৫৪,২৬৯ পৃঃ, সহীহ্ মুসলিম-২৫৪ পৃঃ, আবু দাউদ-১/১৮৯ পৃঃ, নাসাঈ-১৪৮ পৃঃ, তিরমিযী-৯৯ পৃঃ, ইবনু মাজাহ্-৯৭,৯৮ পৃঃ) উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে তারাবীহর সলাতে প্রতি চার রাক‘আত শেষে যে দু’আ ‘সুবহানাজিল মুলকী.....’ নামে পড়া হয় তার কোন দলীল নেই বরং বিদ‘আত। অনুরূপ খতম পড়ার নামে মোরগের ঠোকরের ন্যায় যে দ্রুত ক্বিরআত, রুকূ, সাজদাহ্ করা হয় তাও হাদীস পরিপন্থী।
.
৬০। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে অধিকাংশ মুসল্লীদের দেখা যায় প্রস্রাবান্তে ঢিলা বা টয়লেট পেপার প্রস্রাবের রাস্তায় স্থাপন করে হাঁটাহাঁটি, পা কুটি মারা, কোথ মারা, কাশি দেওয়া ইত্যাদি কাজে অভ্যস্ত থাকতে। অতঃপর পানি ব্যবহার করা হয়। অথচ প্রস্রাব হতে পবিত্রতা অর্জনের জন্য এই প্রকার কার্যকলাপের দলীল কোন সহীহ্ হাদীসে নেই।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ পানির দুষ্প্রাপ্যতায় সহীহ্ হাদীস মতে মাটির ঢিলা, পাথর ব্যবহার করা যায়, কিন্তু তা নিয়ে হাঁটাহাঁটি, পা কুচি মারা, কোথ মারা, কাশি দেওয়া ইত্যাদির দলীল নেই। সহীহ্ হাদীস মতে কমপক্ষে ৩টি পাথর বা মাটির ঢিলা দিয়ে প্রস্রাবের দ্বার মুছে ফেলাই যথেষ্ট। ঢিলা ব্যবহার করলে আর পানির প্রয়োজন নেই। প্রমাণ দেখুন- আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ ‘‘ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বের হলে আমি তাঁর অনুসরণ করলাম। তিনি কোন দিকে তাকাতেন না, আমি তাঁর নিকটবর্তী হলে তিনি বললেন, কয়েকটি কঙ্কর চাই। ওটা দিয়ে আমি শৌচ কাজ করব, কিন্তু হাড় কিংবা গোবর আনবে না। আমি তাঁর জন্য কাপড়ের খুঁটে করে কয়েকটি কঙ্কর এনে তার পাশে রেখে চলে গেলাম। তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজনে সমাধা করে সেগুলো ব্যবহার করলেন। (সহীহ্ আল বুখারী-১ম খন্ড আ.প্র. ১০৯ পৃঃ, হা/ ১৫২, সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড ই.ফা.বা-৩৪ পৃঃ হা/৩৪ পৃঃ হা/৪৯৭,৪৯৮। ঢিলা কুলুখের পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) পুনরায় আর পানি ব্যবহারের কথা বলেননি, উপরন্তু বললেন, এটাই যথেষ্ট (দেখুন-আবু দাউদ ই.ফা.বা. হা/ ৪০ অনুরূপ পানি ব্যবহারের পূর্বে ঢিলা কুলুখ ব্যবহারের কোন প্রমাণ নেই। (দেখুন সহীহ্ বুখারী ১৪ খন্ড আ.প্র. পৃঃ ১০৮ হা/ ১৪৭,১৪৯ সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড ই.ফা.বা পৃঃ ৩৯, হা/ ৫১০,৫১১,৫১২, আবু দাউদ ১ম খন্ড ই.ফা.বা হা/ ৪৩।
........................................................................
বইটির নামঃ'' প্রচলিত ভুল বনাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সলাত আদায়ের পদ্ধতি।''এই গ্রন্থে নামাজের ১০১ টির অধিক ভুলের দলিলসহ সমাধান পেশ করা হয়েছে।
লেখকঃ সাইখ মুরাদ বিন আমজাদ
No comments:
Post a Comment