Thursday, January 26, 2017

সমাজের প্রচলিত নামাজের ভুল ৫১-৫৫




৫১। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাযে ফরয সলাত শেষ হলেই ইমাম মুক্তাদি মিলে দলবদ্ধ হয়ে মুনাজাত করা বহুল প্রচলিত। সমাজে এভাবে ব্যাপকভাবে দু’আ হয়ে আসছে। অথচ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) থেকে এ ব্যাপারে কোন বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া যায়না। সাহাবী তাবেঈদের যুগেও এর সহীহ্ সনদ ভিত্তিক কোন প্রমাণ মিলেনা। এমনকি নাবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) থেকে সহীহ্ তো দুরের কথা যঈফ বা মাওযূ বর্ণনাও পাওয়া যায় না। তাই একাজ সম্পূর্ণ সুন্নাহ বিরোধী, তথা বিদ’আত যা-পরিত্যাগ করা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে মুসলিম সমাজ এই বিদ’আতটিকে একটি সুন্নাত তো বটেই বরং ফরযের মতই মনে করে। যার কারণে আপনি দেখবেন, যদি আপনি ফরয সলাত শেষে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এর সহীহ সুন্নাহ্ অনুযায়ী প্রমাণিত দু’আ যিকিরে মাশগুল হন, ওদের সাথে বিদ’আতী মুনাজাত শরীক না হন তবে অন্যান্য মুসল্লীরা আপনার প্রতি বাঁকা নজরে দেখবে, যেন আপনি মস্তবড় একটি অপরাধ করেছেন। আর ইমাম সাহেব যদি কখনও এই মুনাজাত ছেড়ে দেয় তবে অনেক ক্ষেত্রে তার চাকুরী নিয়ে টানাটানি হযে যাবে। উল্লেখ্য যে, উল্লিখিত বিষয়টিকে মুনাজাত বলাও ঠিক নয় এটা শব্দগত দিক দিয়েও ভুল। বিস্তারিত দেখুন এই দীনহীন লেখকের ‘সহীহ্ আক্বীদার মানদন্ডে তাবলীগী নিসাব’ নামক গ্রন্থের আখেরী মুনাজাত অধ্যায়।
.
নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতিঃ সালাম ফিরানোর পরে নিম্মোক্ত দু’আসমূহ পাঠ করা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত-
.
ক) আল্লাহ আকবার (একবার), আসতাগফিরুল্লাহ (তিনবার).... (মুত্তাফাকুন আলাইহি, মিশকাত-হা/৯৫৯)
.
খ) ‘আল্লা-হুম্মা আনতাস্ সালা-মু ওয়া মিন্কাস্ সালা-মু, তাবারক্তা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইক্রাম’ (সহীহ মুসলিম, মিশকাত-হা/৬০)। তাছাড়া আরও অন্যান্য দু’আ সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। বিস্তারিত জানার জন্য এ লেখকের অনুদিত গ্রন্থ ‘মুসলিমের দু’আ’ বইটি দেখুন। আল্লাহ্ আমাদের সকল মুসলিম ভাই বোনকে সলাত সহ জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে আল-কুরআন ও সহীহ্ সুন্নাহর অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন।
.
৫২। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে মাগরিবের আযানের পর ফরযের পূর্বে সুন্নাত পড়া হয় না। অথচ ইচ্ছা করলে দু’রাক‘আত পড়া যায়।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ আবদুল্লাহ বিন মুগাফফাল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা মাগরিবের পূর্বে দুই রাক‘আত সলাত আদায় কর। তোমরা মাগরিবের পূর্বে দু’রাক‘আত সলাত আদায় কর। কিন্তু তৃতীয়বার বললেন, যার ইচ্ছা পড়বে, এটা আমি এই জন্য বললাম যাতে লোকে এটাকে (অপরিহার্য) সুন্নাহরূপে গ্রহণ না করে। (মুত্তাফাকুন আলাইহি, সহীহ বুখারী ই.ফা. বা-হা/১১০৭, ১১০৮, মিশকাত মাদ্রাসার পাঠ্য-২/হা/ ১০৯৭, ১১১১,১১১৩) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা যখন মাদ্বীনাতে ছিলাম তখন মুয়ায্যিন মাগরিবের সলাতের আযান দিতো, তখন লোকেরা তাড়াহুড়া করে মাসজিদের খুঁটিসমূহের দিকে যেতেন এবং দু’রাক‘আত সলাত পড়তেন। এমনকি কোন নবাগত আগন্তুক ব্যক্তি এসে মাসজিদে প্রবেশ করলে সেই লোকদের সলাত পড়ার অবস্থা দেখে মনে করত যে, সম্ভবত জামাআত শেষ হয়ে গেছে। এই জন্য যে, ঐ দু’রাক‘আত সলাত অনেক বেশী লোকে পড়ত। (সহী মুসলিম, মিশকাত মাদ্রাসার পাঠ্য-২/হা/১১১২, সহীহ বুখারী-আযিযুল হক হা/ ৬২৭, ৬২৮)
.
৫৩। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে জুমু‘আ মাসজিদে জামাআত হওয়ার পর দ্বিতীয় জামাআত জায়েয নেই বলে ফাতওয়া দেওয়া হয়ে থাকে অথচ তার কোন সহীহ্ ভিত্তি নেই। বলা হয়ে থাকে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মতে ফরয সলাতের জন্য ছানী জামাআত (অর্থাৎ মাসজিদে একবার জামাআত হয়ে গেলে আবার দ্বিতীয়বার ঐ মাসজিদে ঐ সলাতের জন্য জামাআত) মাকরূহ তাহরীমা। (ফাতওয়ায়ে দারুল উলুমুত্ত বেহেস্তী গওয়াহের এর উদ্বৃতিতে আহকামে যিন্দেগী-১৫)।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ প্রয়োজনবোধে একই মাসজীদ একাধিকবার এক ওয়াক্তের সলাত জামাআতে আদায় করতে পারবে। প্রথমবার ব্যতীত সব সলাত নফল হিসাবে গণ্য হবে। আবু সাইদ খুদরী (স.) বলেন : জনৈক ব্যক্তি প্রবেশ করেছে তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সলাত শেষ করেছেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তোমাদের মধ্যে কে আছে যে এই ব্যক্তির সাথে দাঁড়িয়ে সাদাকা করার সওয়াব গ্রহণ করবে? তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে পুনরায় তার সাথে সলাত আদায় করলেন। বায়হাকীর বর্ণনায় আছে যে, আবু বক্বর (রাঃ) দাঁড়ালেন এবং তার সাথে সলাত আদায় করলেন, অথচ তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এর সাথে সলাত আদায় করেছেন। মুসান্নাফে আবদুর রাযযাকে আবু উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আনাস বিন মালিক (রাঃ) তার সাথীদেরকে নিয়ে আমাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় বললেনঃ ‘‘তোমরা কি সলাত পড়েছ? আমরা বললাম, হ্যাঁ। আবু উসমান বললেন, অতঃপর আনাস তাঁর আরোহী থেকে নামলেন এবং সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁর সাথীদের ইমামতি করে তাঁদের নিয়ে সলাত পড়লেন। রায়হাকীর বর্ণনায় আছে উসমান বলেনঃ ‘‘ আমরা ফজরের সলাত পড়ে বানী রিকায়াহ মাসজিদে বসেছিলাম।’’ (সহীহ বুখারী-১/৮৯ পৃঃ, তিরমিযী-৫৬ পৃঃ, আবু দাউদ-৬৫ পৃঃ, বায়হাকী-৩য় খন্ড ৯৮,৯৯ পৃঃ)
.
৫৪। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে সলাতে ইমামের ভুল হলে মুক্তাদিরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ইমাম সাহেবকে সতর্ক করে থাকেন। অথচ ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সতর্ক করার কোন বিশুদ্ধ প্রমাণ নেই।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ সলাতে ইমাম সাহেবের ভুল হলে যে কোন মুক্তাদি ‘সুবহানাল্লাহ’ বলে ইমাম সাহেবকে সতর্ক করে দিবেন এবং মহিলা মুক্তাদি ‘হাতে তালি বাজিয়ে’ ইমাম সাহেবকে সতর্ক করে দিবেন। (সহীহ বুখারী- আ.প্র. ১/হা/৬৪৩, সহীহ মুসলিম-ই.ফা.বা-২/হা/ ৮৩২, ৮৩৭, ৮৩৮, ৮৩৯)
.
৫৫। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের সমাজে নারীগণ মাসজিদে জামাআতে শরীক হয় না। শহরে বিভিন্ন মাসজিদে জামাআতের সময় লক্ষ্য করা যায় সলাতের সময় হলে পুরুষগণ নারীদেরকে মাসজিদের এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে রেখে সলাত আদায় করে নেন। অথচ ঐ নারীর প্রতিও সলাত ফরয। তথাপিও ভ্রান্ত ফাতওয়ার জন্য সে মাসজিদে প্রবেশ করে সলাত আদায় করতে পারে না। মাসজিদের নারীদের জন্য পর্দা সহ সলাতের একটি স্থান থাকা দরকার যা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এর যুগ থেকে আজও মাসজিদে নববীতে মওজুদ আছে।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতিঃ আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) ফজরের সলাত আদায় করতেন আর তাঁর সঙ্গে অনেক মুমিনা মহিলা চাদর দিয়ে গা ঢেকে শরীক হত, অতঃপর তারা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যেত আর তাদেরকে কেউ চিনতে পারত না। (সহীহ বুখারী-১/আ.প্র.হা/১৮৫-৮২৪ পৃঃ, ই.ফা. বা-৩৬৫, তিরমিযী-হা/৫৯)

...
........................................................................
বইটির নামঃ'' প্রচলিত ভুল বনাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সলাত আদায়ের পদ্ধতি।''এই গ্রন্থে নামাজের ১০১ টির অধিক ভুলের দলিলসহ সমাধান পেশ করা হয়েছে।
লেখকঃ সাইখ মুরাদ বিন আমজাদ

No comments:

Post a Comment