সালাতুর রাসূল (সা:): (পর্ব-৫)
-------------------------
বুকে হাত বাঁধা: বিরোধীদের দলিল ও তার জবাব:
----------------------------------------
নাভীর নীচে হাত বাঁধার ক্ষেত্রে আহমাদ ও আবু দাঊদ বর্ণিত নীচের হাদীছটি দলীল হিসেবে পেশ করা হয়।
عَنْ أَبِىْ جُحَيْفَةَ أَنَّ عَلِيًّا رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ مِنْ السُّنَّةِ وَضْعُ الْكَفِّ عَلَى الْكَفِّ فِي الصَّلَاةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
আবু জুহায়ফাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, আলী (রাঃ) বলেছেন, সুন্নাত হল ছালাতের মধ্যে নাভীর নীচে হাতের পাতার উপর হাতের পাতা রাখা। [আবুদাঊদ হা/৭৫৬; আহমাদ ১/১১০; দারাকুৎনী ১/২৮৬; ইবনু আবী শায়বাহ ১/৩৯১; বায়হাক্বী ২/৩১। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় ছাপা আবুদাঊদে উক্ত মর্মে কয়েকটি হাদীছ নেই।]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি নিতান্তই যঈফ। উক্ত সনদে আব্দুর রহমান ইবনু ইসহাক নামে একজন রাবী আছে। সে সকল মুহাদ্দিছের ঐকমত্যে যঈফ। [وَقَدِ اتَّفَقَ الْأَئِمَّةُ عَلَى تَضْعِيْفِهِ -তানক্বীহ, পৃঃ ২৮৪] ইমাম বায়হাক্বী বলেন, ‘উক্ত হাদীছের সনদ ছহীহ বলে প্রমাণিত হয়নি। আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক্ব একাকী এটা বর্ণনা করেছে। সে পরিত্যক্ত রাবী।[ لَمْ يَثْبُتْ إِسْنَادُهُ تَفَرَّدَ بِهِ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنِ إِسْحَاقَ الْوَاسِطِىِّ وَهُوَ مَتْرُوْكٌ -বায়হাক্বী, আল-মা‘রেফাহ ১/৪৯৯] আল্লামা আইনী হানাফী (মৃঃ ৮৫৫ হিঃ) বলেন, ‘এর সনদ ছহীহ নয়’।[ إِسْنَادُهُ غَيْرُ صَحِيْحٍ -উমদাতুল ক্বারী ৫/২৮৯] ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২) বলেন, এর সনদ যঈফ’।[ إسناده ضعيف -ইবনু হাজার আসক্বালানী, আদ-দিরায়াহ ১/১২৮] শায়খ আলবানীও যঈফ বলেছেন।[যঈফ আবুদাঊদ হা/৭৫৬]
যেমন আরও একটি হাদীছ, ‘সুন্নাত হল ছালাতের মধ্যে নাভীর নীচে হাতের পাতা রাখা’ (এই বর্ণনা সঠিক নয়)।[মিশকাত হা/৭৯৮ -এর টীকা দ্রঃ, ১/২৪৯ পৃঃ।] ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত উক্ত হাদীছের অনুবাদ করতে গিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুবাদে ‘ডান হাত বাম হাতের কবজির উপরে’ মর্মে অনুবাদ করা হয়েছে [বুখারী শরীফ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, নবম সংস্করণ, জানুয়ারী ২০১২), ২য় খন্ড, পৃঃ ১০২, হা/৭০৪] আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত বুখারীতেও একই অনুবাদ করা হয়েছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭০৪ ও আধুনিক প্রকাশনীর ৬৯৬ হাদিসে তারা হাত বাধার হাদিসটি উল্লেখ করতে গিয়ে একটি বিকট জালিয়াতি করেছে, বুখারী আরবী ইবারতে তারা ‘যিরা’ শব্দের অর্থ করেছেন কব্জি , কিন্তু এমন কোন আরবী ডিক্সনারি নেই যেখানে ‘যিরা’ শব্দের অর্থ কব্জি করা হয়েছে।
অথচ ইসলমিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত একই খন্ডের মধ্যে অন্যত্র এর অর্থ করা হয়েছে ‘বাহু’ [বুখারী শরীফ ২য় খন্ড, পৃঃ ৯, হা/৫০৭; ৭ম খন্ড, পৃঃ ২৩১, হা/৪০৭৬; ছহীহ বুখারী হা/৫৩২, ১/৭৬ পৃঃ ও হা/৪৪২১] কিন্তু ‘বাহু’ আর ‘কব্জি’ কি এক বস্ত্ত? সব হাদীছ গ্রন্থে ‘যিরা’ অর্থ ‘বাহু’ করা হয়েছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) ওযূ করার সময় মুখমন্ডল ধৌত করার পর বাহুর উপর পানি ঢালতেন [ছহীহ মুসলিম হা/১৫৯৭, ‘মসজিদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫৬, উল্লেখ্য যে, ভারতীয় ছাপায় হাদীছটি নেই, ১/২৪০-২৪১; মিশকাত হা/৩৯২২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৭৪৬, ৮/২২ পৃঃ; আবাদাঊদ হা/১৩৫, ১/১৮ পৃঃ; মুসনাদে আহমাদ হা/১০০৮] অতএব কোন সন্দেহ নেই যে, নাভীর নীচে হাত বাঁধার ত্রুটিপূর্ণ আমলকে প্রমাণ করার জন্যই উক্ত কারচুপি করা হয়েছে। আরবী ডিক্সনারিতে যিরা শব্দের অর্থ একগজ বিশিষ্ট হাত। কব্জির আরবী অর্থ হচ্ছে ‘রুসগু’।
যরূরী জ্ঞাতব্য: ভারতীয় ছাপা আবুদাঊদে হাত বাঁধা সংক্রান্ত একটি হাদীছও উল্লেখিত হয়নি। এর কারণ সম্পূর্ণ অজানা। তবে ইমাম আবুদাঊদ নাভীর নীচে হাত বাঁধা সম্পর্কে বর্ণিত বর্ণনাগুলোকে যঈফ বলেছেন। আর বুকের উপর হাত বাঁধার হাদীছটিকে ছহীহ হিসাবে পেশ করতে চেয়েছেন। কারণ উক্ত হাদীছ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। সে জন্যই হয়ত কোন হাদীছই উল্লেখ করা হয়নি।[আবুদাঊদ, পৃঃ ১২২]
বিভ্রান্তি থেকে সাবধান :
-------------------
বাজারে প্রচলিত ‘নামায শিক্ষা’ বইগুলোতে উক্ত যঈফ, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বর্ণনা দ্বারা নাভীর নীচে হাত বাঁধার দলীল পেশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে মাওলানা আব্দুল মতিন প্রণীত ‘দলিলসহ নামাযের মাসায়েল’ একটি। উক্ত লেখক শুধু বানোয়াট বর্ণনাই পেশ করেননি, বরং রীতি মত ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করে রাসূল (ছাঃ)-এর আমলকে যবাই করে নিজেদেরকে ‘প্রকৃত আহলে হাদীস’ বলে দাবী করেছেন।[দলিলসহ নামাযের মাসায়েল , পৃঃ ২৪] কথায় বলে ‘অন্ধ ছেলের নাম পদ্মলোচন’। কারণ অন্ধ মাযহাবের মরণ ফাঁদে পড়ে কেউ আহলেহাদীছ পরিচয় ব্যক্ত করতে পারে না। এ জন্য ‘আহলেহাদীছ’ পরিচয় দেয়ার সাহস হয় না।
উল্লেখ্য যে, বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখা সম্পর্কে ১৮ জন ছাহাবী ও ২ জন তাবেঈ থেকে মোট ২০টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে এর বিপরীত কিছুই বর্ণিত হয়নি এবং এটাই জমহূর ছাহাবা ও তাবেঈনের অনুসৃত পদ্ধতি। [নায়লুল আওত্বার ৩/২২; ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো : ১৪১২/১৯৯২) ১/১০৯]
মন্তব্য এবং আমাদের করণীয়:
-----------------------
আজকের সমাজের নামধারী আলেম-ওলামা, ঈমাম-মৌলভী সাহেবরা জাল এবং জয়ীফ হাদিসের দোহাই দিয়ে মানুষকে সহিহ হাদিস থেকে দুরে রাখছে। উপুরন্তু কেউ যদি বুকে হাত বেঁধে নামাজ পড়ে তবে তাকে নিয়ে কটু কথা বলছে। আবার অনেকে রাসুলুল্লাহ (সা:) এর উপরে মিথ্যা আরোপের মত বেয়াদবিও করছে। যেমন কেউ কেউ বলছে রাসুলুল্লাহ (সা:) যখন যৌবনে ছিলেন তখন বুকে হাত বেঁধে নামাজ পড়তেন। আবার যখন বার্ধক্যের দিতে যেতে থাকলেন তখন বুকে হাত বাঁধতে কষ্ট হতো বিধায় নাভির নিচে বাঁধতেন (নাউজুবিল্লাহ)। আবার কেউ কেউ বলে রাসুলুল্লাহ (সা:) দুই ভাবেই নামাজ পড়তেন। কখনো বুকে আবার কখনো নাভির নিচে হাত বেঁধে। রাসুলুল্লাহ (সা:) এর শানে কতো বড় বেয়াদবি। এটা কি কখনো সম্ভব যে তিনি এক এক সময় এক এক ভাবে নামাজ পড়তেন। আবার কেউ কেউ বলে, ইসলামের প্রথম যুগে রাসুলুল্লাহ (সা:) বুকে হাত বেঁধে নামাজ পড়তেন। কিন্তু পরে এভাবে নামাজ পড়া রহিত হয়ে যায়। শেষ যুগে তিনি নাভির নিচে হাত বেঁধেই নামাজ পড়েছিলেন। এভাবে এক এক জন এক এক ভাবে মিথ্যাচার করছে এবং নিজ নিজ মতামত কে, নিজেদের তৈরী বিদআত কে প্রতিষ্ঠিত এবং সত্য প্রমান করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা:) এর উপরেও মিথ্যারোপ করতে কুন্ঠা বোধ করছেনা। তাই সবার কাছে অনুরোধ উপরের সহিহ এবং জাল হাদিস গুলো জেনে, বুঝে, পর্যালোচনা করে তারপরে সত্য এবং মিথ্যা নির্ণয় করে সহিহ আমল করুন, সহিহ নিয়মে নামাজ পড়ুন।
No comments:
Post a Comment