Thursday, January 26, 2017

সমাজের প্রচলিত নামাজের ভুল ১৬-২০





ভুল ১৬-২০
.
১৬ / প্রচলিত ভুলঃ প্রচলিত সলাতে নারীগণ বুকের উপর এবং পুরুষগণ নাভির নীচে হাঁত বাঁধে যার কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নাই। এক্ষেত্রে আহমাদ ও আবু দাউদ বর্ণিত হাদিসটি দলীল হিসাবে পেশ করা হয়। আলী (রাঃ) বলেনঃ ‘‘সুন্নাত হচ্ছে সলাতে ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে নাভীর নীচে রাখা।’’ কিন্তু হাদিসটির সনদ দুর্বল, তাই উহা আমলযোগ্য নয়, তার বিপরীত সহীহ হাদীস নিম্মে উল্লেখ করা হলো।

* রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ সাহল বিন সা’য়াদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ সলাতে লোকদেরকে ডান হাত বাম হাতের বাহুর উপর স্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হতো। (সহীহ বুখারী আঃ প্রঃ হা/৬৯৬, সহীহ্ মুসলিম ২/হা/৭৮০, ইফাবা আবু দাউদ ১/হা-৭৫৯।
.

১৭। প্রচলিত ভুল পদ্ধতিঃ আমাদের সলাতে মুক্তাদিগণ ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না। অথচ সূরা ফাতিহা ছাড়া সলাত হয় না। (মিশকাত মাদ্রাসার পাঠ্য-২/৩৩০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে মুক্তাদিদের সূরা ফাতিহা পড়া জায়েজ নয়।)
.
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি এমন সলাত পড়ল যাতে সূরা ফাতিহা পড়ে নাই সে সলাত ত্রুটিপূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ তথা অসম্পূর্ণ’’ (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম)। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) একদা ফজরের সলাত শেষে বলেন, তোমরা কি ইমামের পিছনে পাঠ কর? আমরা বললাম, হাঁ দ্রুত পড়ে নিই। তিনি বললেন, এরূপ করো না। তবে সূরা ফাতিহা পড়ে নিও। কেননা যে ব্যক্তি এ সূরা পড়বে না তার সলাত হবে না। (আবু দাউদ, তিরমিযী) তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি সলাতে সূরা ফাতিহা পড়ল না তার সলাত হল না। (সহীহ বুখারী ১/১০৪ পৃঃ)
.
১৮। প্রচলিত ভুলঃ আমাদের দেশে জেহ্রী সলাতে উচ্চৈস্বরে আমীন বলা হয় না, যা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) ও সাহাবাদের আমলের বিপরীত। বরং ইমাম ও মুক্তাদির সকলকেই সরবে আমীন বলতে হবে। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) জেহ্রী সলাতে উচ্চৈস্বরে আমীন বলতেন এবং মুক্তাদিদেরও উচ্চৈস্বরে বলার নির্দেশ দিতেন।
.
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ আবু হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) বলেন, ইমাম যখন আমীন বলে তখন তোমরাও আমীন বলো। কেননা যার আমীন বলা ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে মিলে যাবে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। তাবেয়ী আতা (রহ) বলেছেন, আমীন হলো দু’আ। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ) এবং তাঁর পিছনে মুক্তাদিরা আমীন বলতেন। এমনকি মাসজিদে গুনগুন শব্দ শোনা যেত। (সহীহ বুখারী) ওয়ায়িল বিন হুজুর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) কে ‘‘গায়রিল মাগযূবি আলাইহিম ওয়ালায্যাল্লীন’’ পড়তে শুনেছি। অতঃপর তিনি নিজের স্বরকে উচ্চ করে আমীন বলেছেন। (তিরমিযী) (বিস্তারিত দেখুন-সহীহ বুখারী ১/১০৭, ১০৮, মুসলিম-১৭৬ পৃঃ, আবু দাউদ- ১৩৪ পৃঃ, তিরমিযী-৫৭,৫৮ পৃঃ নাসাঈ-১৪০ পৃঃ, ইবনু মাজাহ-৬২ পৃঃ, মিশকাত-৭৯-৮০ পৃঃ)
.
১৯। প্রচলিত ভুলঃ অধিকাংশ মুসল্লী শুধুমাত্র তাকবীর তাহরীমা অর্থাৎ সলাত শুরুর তাকবীর বলার সময় ‘রফউল ইয়াদাঈন’ বা হাত উত্তোলন করে থাকে; কিন্তু পরবর্তীতে রুকুর আগে ও পরে তা করে না (আবার অনেকে তাকবীরে তাহরীমার সময়ও করে না)- এটা সুন্নাত বিরোধী।
.
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতিঃ আবদুল্লাহ ইবনে‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) কে দেখেছি তিনি যখন সলাতের জন্য দাঁড়াতেন তখন উভয় হাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন এবং তিনি যখন রূকু’র জন্য তাকবীর বলতেন তখনও এরূপ করতেন (হাত উঠাতেন)। আবার যখন রূকু হতে মাথা উঠাতেন তখনও এরূপ করতেন। ইমাম বুখারী এটা বর্ণনা করেছেন। তাঁর অপর বর্ণনায় এটাও আছে যে, যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) দ্বিতীয় রাক‘আত হতে তৃতীয় রাক‘আতের জন্য দাঁড়াতেন তখনও দুই হাত (কাঁধ বরাবর) উঠাতেন। (সহীহ বুখারী-১/১০২ পৃঃ, সহীহ মুসলিম-১৬৮ পৃঃ, আবু দাউদ-১/১০৪, ১০৫ পৃঃ, তিরমিযী-১/৫৯ পৃঃ, নাসাঈ-১৪১-১৫১, ১৬২ পৃঃ, ইবনু খুজাইমাহ-৯৫,৯৬, মিশকাত-৭৫ পৃঃ, ইবনে মাজাহ-১৬৩ পৃঃ,, যা‘আদুল মা‘আদ-১/১৩৭, ১৩৮, ১৫০ পৃঃ, হিদায়া দিরায়াহা-১১৩-১১৫ পৃঃ, মিশকাত মাদ্রাসার পাঠ্য-২/৭৩৮-৭৩৯, ৭৪৯, ৭৪১, ৭৪৫ পৃঃ, ইসলামিয়াত বি,এ হাদীস পর্ব-১২৬-১২৯ পৃঃ)
.
উল্লেখ্য যে, দু’হাত তুলা প্রসঙ্গে কিছু লোক সহীহ হাদীসের উপর আমল না করার জন্য ভান করে মিথ্যা ও বানোয়াট কথার আশ্রয় নিয়ে বলে যে, ইসলামের প্রথম যুগে পুতুল পুজারী নও মুসলিমরা সলাতের সময়ও বগলে পুতুল নিয়ে আসতো। তাই নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) তাদেরকে রুকুতে যাবার ও রুকু হতে মাথা তোলার সময় দু’হাত তুলতে বলেছিলেন। এসব কথা কোন হাদীসে তো দূরের কথা এমনকি ইতিহাসেও প্রমাণহীন। বরং তা ভিত্তিহীন মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়। যারা এসব কথা বলে তাদের ভয় করা উচিৎ যে, এই মিথ্যা অপবাদটি স্বয়ং রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এর উপর ও তাঁর সাহাবীদের উপর পড়ে (নাউযুবিল্লাহ) কারণ তাঁরা মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত রুকুর পূর্বেও পরে হস্তদ্বয় উত্তোলন করেছেন। (বায়হাকী, তালখীসুল হাবীব ৮১ পৃঃ আদদেরায়াহ-৮৫ পৃঃ) সাবধান! এ অপবাদই জাহান্নামী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই মর্মে আবু দাউদে বর্ণিত যা সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেনঃ তিনি (স.) কেবলমাত্র তাকবীরে তাহরীমার সময় ১ বার দু’হাত তুলতেন। (আবু দাউদ, মিশকাত, ৭৭ পৃঃ) কিন্তু এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম আবু দাউদ (রহঃ.) নিজেই বলেন, হাদীসটি সহীহ নয় (মিশকাত ৭৭ পৃঃ) মোল্লা আলী ক্বারী আল হানাফী (রহঃ) বলেনঃ সলাতের রুকুতে যাবার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় দু’হাত না তুলা সম্পর্কে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেগুলো সবই বাতিল হাদীস। তন্মধ্যে একটিও সহীহ নয়- যেমন ইবনে মাসুদের (রা.) হাদীস। (মাউযুআতে কাবীর ১১০ পৃঃ আইনী তুহফা-১/১৩১ পৃঃ) লক্ষনীয় যে, হানাফী মাযহাবের বিশিষ্ট মুহাদ্দীস আল্লামাহ আইনী আল-হানাফী (রহঃ) রুকুতে যাওয়ার আগে দু’হাত তুলার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সম্পর্কে লিখেছেনঃ ইমাম আবু হানীফা হতে বর্ণিত যে, তা অর্থাৎ রফউল ইয়াদাইন ত্যাগ করলে গুনাহ হবে। (ওমদাতুল ক্বারী-দারুল ফিকর ছাফা, ৫/২৭ পৃঃ আইনী তুহফা-১/১৩১ পৃঃ) অতএব প্রতিটি মুসলিমের প্রতি আমার অনুরোধ আল্লাহকে ভয় করুন, গোড়ামী ও মিথ্যার আশ্রয় বাদ দিয়ে সহীহ হাদীসের উপর আমল করুন। কারণ ইমাম আবু হানীফা (রহ.) বলেছেন, ‘সহীহ হাদীস পেলে সেটাই আমার মাযহাব বলে গণ্য করবে।’
.

২০। প্রচলিত ভুলঃ প্রচলিত সলাতের প্রথম ও তৃতীয় রাক‘আতে অর্থাৎ বেজোড় রাক‘আতে সাজদাহ্ হতে উঠে ‘না বসে’ সোজা দাঁড়িয়ে যাওয়া হয়। এটা সুন্নাত বিরোধী। ‘দাঁড়াইবার সময় বসিবেনা এবং হাত দিয়া মাটিতে ভর করিয়া দাঁড়াইবে না।’ (কুদুরী-৬৬ পৃঃ)
.
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদ্ধতিঃ মালিক ইবন হয়াইরিস আল-লাইসা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) কে সলাত পড়তে দেখেছেন। যখন তিনি তাঁকে সলাতে বেজোড় রাক‘আতে (সাজদাহ্ হতে) দাঁড়াতেন তখন তিনি সোজা না বসে দাঁড়াতেন না। (সহীহ বুখারী-১/১১৩ পৃঃ, আবু দাউদ ১১১, ১১২ পৃঃ, নাসাঈ-১৭৩ পৃঃ, ইবনু মাজাহ-২৬৪ পৃঃ, মিশকাত-৭৫ পৃঃ, তিরমিযী ই.ফা.বা.-১-হা/৭৬৯

.........................................................................
বইটির নামঃ'' প্রচলিত ভুল বনাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সলাত আদায়ের পদ্ধতি।''এই গ্রন্থে নামাজের ১০১ টির অধিক ভুলের দলিলসহ সমাধান পেশ করা হয়েছে।
লেখকঃ সাইখ মুরাদ বিন আমজাদ

No comments:

Post a Comment