Wednesday, March 1, 2017

আল্লাহ কি নিরাকার ? পর্ব-৩





আল্লাহ কি নিরাকার? 
(পর্ব-০৩)
.
বিজ্ঞ পাঠক! 
সমাজে প্রচলিতে একটি আক্বীদা হচ্ছে
যে, “আল্লাহ নিরাকার” এবং অধিকাংশ মানুষ এই আক্বীদায় বিশ্বাসী। এমনকি অধিকাংশ আলেমও এর পক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কুরআন ও হাদীস এ সম্পর্কে কি বলে?
.
পর্যালোচনাঃ
আল্লাহ তা’আলা নিরাকার নন, তার
আকার আছে, তবে কোন কিছুর সাথে তা তুলনীয় নয়। কুরআন ও সহীহ হাদীসে তার আকৃতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তার কোন রুপক বা বিকৃত অর্থ করা যাবে না।
বরং বলতে হবে তিনি তার মত। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যে নিরাকার নন, তার
সমর্থনে নিম্মে কিছু উদাহারণ দেয়া
হলঃ
.
আল্লাহর চেহারাঃ
আল্লাহ তা’আলা আল-কুরআনের চৌদ্দটি
(১৪ টি) আয়াতে তার চেহারার প্রমাণ
দিয়েছেন। -আক্বীদাতুল মুসলিমীন
(খন্ডঃ ০২; পৃষ্ঠাঃ ৪৬৬)। 
.
নিম্নে তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হলঃ
(১) আল্লাহ বলেন, “তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও সেদিকেই আল্লাহর চেহারা রয়েছে।” 
–সূরা বাকারাহ (২:১১৫)

(২) আল্লাহ বলেন, “ভূ-পৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার চেহারা ব্যতীত।” –
সূরা আর-রহমান (৫৫:২৬-২৭)
.
(৩) আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর মুখমন্ডল (সত্ত্বা) ব্যতীত সবকিছু ধ্বংসশীল।” –
(সূরা কাসাস (২৮:৮৮)
.
(৪) আল্লাহ বলেন, “অতএব আত্মীয়কে দিয়ে দাও তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও তার মুসাফিরকেও। যারা আল্লাহর
চেহারা (দর্শন) কামনা করে তাদের
জন্যে এটা শ্রেয় এবং তারাই সফলকাম।”
-সূরা রুম (৩০:৩৮)

(৫) আল্লাহ বলেন, “বরং শুধু তার মহান প্রতিপালকের মুখমন্ডল (সন্তোষ) লাভের প্রত্যাশায়।” 
–সূরা লাইল (৯২:২০)
.
(৬) আল্লাহ বলেন, “(তারা বলে) কেবল আল্লাহর মুখমন্ডল (সন্তুষ্টি) লাভের জন্য আমরা তোমাদেরকে খাদ্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।” 
–সূরা দাহর/
সূরা ইনসান (৭৬:৯)
.
আল্লাহর চেহারা সম্পর্কিত আরো
কয়েকটি আয়াতঃ সূরা বাকারা (২:২৭২);
সূরা রা’দ (১৩:২২); সূরা আন’আম (৬:৫২)
এবং সূরা রুম (৩০:২২)
.
(৭) জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা.) হতে
বর্নিত। তিনি বলেন, এ আয়াত যখন
অবতীর্ন হলঃ “হে নাবী (স.)! আপনি বলে দিন উপর থেকে তোমাদের প্রতি শাস্তি পাঠাতে তিনিই সক্ষম।” 
[সূরা আন’আম (৬:৬৫)]। 
নাবী (স.) বললেনঃ হে আল্লাহ!
আমি আপনার সত্ত্বার (চেহারার)
সাহায্যে আশ্রয় চাচ্ছি। আল্লাহ তখন
বললেনঃ “কিংবা তোমাদের পায়ের নিচ হতে” তখন নাবী (স.) বললেন, আমি আপনার সত্ত্বার (চেহারার) সাহায্যে আশ্রয় চাচ্ছি। আল্লাহ বললেনঃ “কিংবা
তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে”
তখন নাবী (স.) বললেনঃ এটি
অপেক্ষাকৃত সহজ।” -সহীহুল বুখারী
(হা/৭০৪৬, ৪৬২৮: তাওহীদ প্রকাশনী);
(হা/৬৯০২: ইসলামিক ফাউন্ডেশন); পর্ব
(৯৭): তাওহীদ; অধ্যায় (১৬):
.
আল্লাহর বাণীঃ আল্লাহর চেহারা ছাড়া সবকিছুই ধ্বংসশীল - 
[সূরা আল-কাসাস (২৮:৮৮)]
.
(৮) রসূল (স.) বলেন, “জান্নাতীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বলবেন, তোমরা কি চাও, আমি আরও অনুগ্রহ বাড়িয়ে দেই?
তারা বলবে, আপনি কি আমাদের
চেহারাগুলো আলোকোজ্জল করে দেন নি, আমাদের জান্নাতে দাখিল করেন নি এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত দেন নি?
রসূল (স.) বলেন, এরপর আল্লাহ তা’আলা (হঠাৎ) আবরণ তুলে নিবেন (এবং তারা তার চেহারা দর্শন লাভ করবে)। আল্লাহর (চেহারা) দর্শন লাভের চেয়ে অধিক পছন্দনীয় জিনিস আর কিছুই তাদের
দেয়া হয় নি।” -সহীহ মুসলিম (হা/১৮১:
ফুয়াদ আল-বাকী কর্তৃক প্রদত্ত); (হা/৩৩৮: হাদীস একাডেমী); (হা/৩৪৬: ইসলামিক ফাউন্ডেশন); (হা/৩৫৭: ইসলামিক সেন্টার) এবং সূনান ইবনু মাযাহ (হা/১৮৭:
আত-তাওহীদ প্রকাশনী)
সুতরাং উল্লেখিত আয়াত ও হাদীসমূহ দ্বারা প্রমাণ হল যে, আল্লাহর চেহারা আছে। অতএব যার চেহারা আছে তিনি নিরাকার নন। বলা বাহুল্য, চেহারা বা মুখমন্ডলের অপব্যাখ্যা করে সওয়াব বা
নেকী বলা বৈধ নয়। যেহেতু তা শাব্দিক অর্থের বিরোধী এবং সলফদের ইজমার
পরিপন্থী।
যেমন, মুআততিলাহ ফির্কা বলেঃ
আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত ‘ওয়াজহুন’ শব্দের অর্থ আল্লাহর প্রকৃত চেহারা নয়। বরং তা হল আল্লাহর সত্ত্বা কিংবা তার সন্তুষ্টি ও নেকী অথবা তার দিক প্রভৃতি।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জাম’আতের মতে ঐ ধারণা ভুল। বরং তা আল্লাহরই মর্যাদাযোগ্য সত্যিকার চেহারা। -আস-
সওয়ায়িকুল মুরসালাত (খন্ডঃ ২; পৃষ্ঠাঃ ১৭৪)
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা’আলার চেহারা বা মুখমন্ডলের সাথে সৃষ্টির মুখমন্ডলের সাদৃশ্য স্থাপন করা যাবে না। কারণ আল্লাহ বলেছেন, “কোন কিছুই তার সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” -সূরা
আশ-শূরা (৪২:১১)।
.
অনুরুপভাবে, তার আকারের সাথে কোন
কিছুর আকারের তুলনা করা যাবে না।
যেমন আল্লাহ নিজেই বলেন, “সুতরাং
তোমরা আল্লাহর কোন সাদৃশ্য বর্ণনা
করো না।” –সূরা নাহল (১৬:৭৪)।
.
যেমন, কেউ যদি আল্লাহকে কোন সৃষ্টির চেহারার মত কল্পনা করে প্রশ্ন করে যে,
“আল্লাহর যেহেতু মুখমন্ডল আছে, তাহলে তার মুখমন্ডলে নাক আছে কি?” তাহলে এ প্রশ্নটি বিদ’আত হলেও উত্তর হবে,
‘জানি না।’ যেহেতু কুরআন ও হাদীসে
তার উল্লেখ নেই। আছে বলেও নেই, নেই বলেও নেই। সুতরাং যা ‘নেই’ বলে উল্লেখ নেই, তার জন্য আমরা মানবীয় চাহিদার উপর ক্বিয়াস করে একথা বলতে পারি না
যে, “অবশ্যই জানি, তার (আল্লাহর) নাক নেই।”
.
আল্লাহর কথা ও সাক্ষাতঃ
আল্লাহ তা’আলা বান্দাকে সম্বোধন
করেন, আদেশ করেন, উপদেশ দেন। তার এ আদেশ, নিষেধ কিংবা উপদেশমূলক বাণী বা কথা অহীর মাধমে বা পর্দার অন্তরাল
থেকে কিংবা দূত মারফত মানুষের কাছে পেীঁছে থাকে।
(১) যেমন আল্লাহ বলেন, “কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যে, আল্লাহ তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন ওহীর (প্রত্যাদেশ) ব্যতিরেকে, অন্তরাল ব্যতিরেকে কিংবা কোন দূত ব্যতিরেকে। আর তখন
আল্লাহ যা চান তার অনুমতিক্রমে অহী (প্রত্যাদেশ) করেন। নিঃসন্দেহে তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়।” –সূরা শূরা (৪২:৫১)
.
(২) আল্লাহ তা’আলা মূসা (আ.) এর সাথে তূর পাহাড়ে কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আমি অনেক রসূলের কথা পূর্বে তোমার নিকট বর্ণনা করেছি এবং অনেক রসূলের কথা তোমার নিকট বর্ণনা করি নি। আর আল্লাহ মূসার
সাথে কথা বলেছেন।” –সূরা নিসা
(৪:১৬৪)
.
(৩) এ প্রসঙ্গে অনত্র আল্লাহ বলেন, “মূসা যখন আমার নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হল এবং তার প্রতিপালক তার সঙ্গে কথা বললেন, তখন সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দর্শন দিন, আমি
আপনাকে দেখব। (তখন) তিনি বললেন, তুমি আমাকে আদৌ দেখতে পাবে না।” –
সূরা আ’রাফ (৭:১৪৩)
.
(৪) রসূল (স.) বলেছেন, “হে জাবির! আমার কি হল, আমি তোমাকে ভগ্ন হৃদয়ে দেখছি কেন? জাবির (রা.) বলেন, আমি বললাম,
হে রসূলুল্লাহ! আমার পিতা শহীদ
হয়েছেন এবং তিনি অনেক সন্তান ও
ঋণের বোঝা রেখে গেছেন। তিনি (স.) বলেন, আমি কি তোমাকে সুসংবাদ দিব না যে, আল্লাহ তা’আলা তোমার পিতার সাথে কিভাবে সাক্ষাত করেছেন? তিনি
বলেন, অবশ্যই, ইয়া রসূলুল্লাহ! তিনি (স.) বলেন, আল্লাহ তা’আলা কখনো অন্তরাল ছাড়া কারো সাথে কথা বলেন নি, কিন্তু তোমার পিতার সাথে অন্তরাল ছাড়াই কথা বলেছেন।….” -সূনান ইবনু মাযাহ (হা/১৯০: হাসান, আত-তাওহীদ প্রকাশনী)
এবং আত-তিরমিযী (হা/৩০১০: হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী)
আল্লাহ তা’আলা আদম-সহ সকল নাবী ও রসূলগণের সাথে কথা বলেছেন। তিনি মি’রাজের রাতে শেষনাবী (স.) এর সাথে কথা বলেছেন। ক্বিয়ামাত দিবসে
তিনি বান্দার সাথে কথা বলবেন। যখন ইচ্ছা তিনি বলেন, যা ইচ্ছা বলেন। যে কোন সময়ে তিনি কথা বলেন। আর সে বলার কোন দৃষ্টান্ত নেই, কোন রকমত্ব নেই। কোন সৃষ্টির বলার মত তার বলা নয়।
মূলত, সম্পূর্ণ কুরআন মাজীদ তারই বলা ‘কালাম’ (বাণী) এবং রসূল (স.) এর মুখ নিঃসৃত বাণীও আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী। সুতরাং যিনি কথা বলতে পারেন, তিনি কি কখনো স্ব-সত্ত্বায় নিরাকার হতে পারেন?

No comments:

Post a Comment