Thursday, September 20, 2018

*কারবালার ঘটনার সাথে আশুরার কি সম্পর্ক ?*



Image may contain: fire



বর্তমানে আমরা দেখছি প্রায় সর্ব মহল থেকে আশুরার মূল বিষয় বলে কারবালার ঘটনাকেই বুঝানো হচ্ছে। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সঠিক নয়।
ইসলামের আগমনের পূর্বে আশুরা ছিল। যেমন আমরা হাদীস দ্বারা জানতে পেরেছি। তখন মক্কার মুশরিকরা যেমন আশুরার সওম পালন করত তেমনি ইহুদীরা মুছা আ. এর বিজয়ের স্মরণে আশুরার সওম পালন করত।
আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশুরার সওম পালন করেছেন জীবনের প্রতিটি বছর। তার ইন্তেকালের পর তার সাহাবায়ে কেরাম রা. আশুরা পালন করেছেন। রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর হিজরী ৬১ সালে কারবালার ময়দানে জান্নাতী যুবকদের নেতা, রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রিয় নাতী সাইয়েদুনা হুসাইন রা. শাহাদাত বরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম উম্মাহর জন্য এটা একটা হৃদয় বিদারক ঘটনা। ঘটনাক্রমে এ মর্মান্তিক ইতিহাস এ আশুরার দিনে সংঘঠিত হয়েছিল। আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লা) ও তার সাহাবায়ে কেরাম যে আশুরা পালন করেছেন ও যে আশুরা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য রেখে গেছেন তাতে কারবালার ঘটনার কোন ভূমিকা ছিলনা। থাকার প্রশ্নই আসতে পারেনা। কারবালার এ দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহবাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. আব্দুল্লাহ বিন উমার রা. আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. আনাস বিন মালেক রা. আবু সাঈদ খুদরী রা. জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. সাহল বিন সায়াদ রা. যায়েদ বিন আরকাম রা. সালামাতা ইবনুল আওকা রা. সহ বহু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তারা তাদের পরবর্তী লোকদের চেয়ে রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার পরিবারবর্গকে অনেক বেশী ভালবাসতেন। তারা আশুরার দিনে কারবালার ঘটনার স্নরণে কোন কিছুর প্রচলন করেননি। মাতম,তাযিয়া মিছিল, আলোচনা সভা কোন কিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না। আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেভাবে আশুরা পালন করেছেন তারা সেভাবেই তা অনুসরণ করেছেন। অতএব আমরা কারবালা কেন্দ্রিক যে আশুরা পালন করে থাকি, এ ধরণের আশুরা না রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পালন করেছেন, না তার সাহাবায়ে কেরাম। যদি এ পদ্ধতিতে আশুরা পালন আল্লাহর রসূলের মুহব্বাতের পরিচয় হয়ে থাকত, তাহলে এ সকল বিজ্ঞ সাহাবাগণ তা পালন থেকে বিরত থাকতেন না, তারা সাহসী ছিলেন। তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতেন না। কিন্তু তারা তা করেননি। তাই যে সত্য কথাটি আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, তা হলো আশুরার দিনে কারবালার ঘটনার স্মরণে যা কিছু করা হয় তাতে আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার সাহাবাদের রেখে যাওয়া আশুরাকে ভুলিয়ে দিয়ে এক বিকৃত নতুন আশুরা প্রচলনের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
আশুরার দিনে সাইয়েদুনা হুসাইন বিন আলী রা. এর শাহাদাত স্মরণে যে তাযিয়া মিছিল করা হয়, যে মাতম করা হয়, আলোচনা সভার ব্যবস্থাসহ যা কিছু করা হয় এর সাথে ইসলামী শরীয়তের কোন সম্পর্ক নেই।
কারণঃ
রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কারো জন্ম বা মৃত্যু দিবস অথবা শাহাদত দিবস পালন করেননি। তারপরে তাঁর সাহাবায়ে কেরাম এ ধরনের কোন আমল করেননি। কেহ বলতে পারেন কারবালার ঘটনা যদি রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবদ্দশায় হত তাহলে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে এর স্মরনে শোক ও মাতম ইত্যাদির ব্যবস্থা করে যেতেন।
আসলে এ ধারনা একেবারেই বাতিল। কারণ রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবনে অনেক মর্মান্তিক ও হ্রদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে। তাঁর প্রিয়তমা সহধর্মীনি খাদিজা রা. র ইন্তেকাল তাকে সহ্য করতে হয়েছে। সাহাবীয়া সুমাইয়া রা. শাহাদত বরণ প্রতক্ষ করতে হয়েছে। তাঁর সামনে তাঁর একাধিক সন্তান ইন্তেকাল করেছেন। উহুদের যুদ্ধে তার প্রিয় চাচা ও দুধ ভাই হামযা রা. শাহাদত বরণ করেছেন। তিনি তার যে কত প্রিয় ছিলেন ও তার শাহাদতে তিনি যে কতখানি মর্মাহত হয়েছিলেন সীরাত পাঠক মাত্রই তা অবগত আছেন। তেমনি মুস'আব বিন উমায়ের রা. সহ অনেক প্রিয় সাহাবী শহীদ হয়েছেন। তিনি তাদের জন্য অনেক ক্রন্দন করেছেনে। এমনকি ইন্তেকালের কয়েকদিন পূর্বে তিনি উহুদের ময়দানে তাদের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। সেখানে তাদের জন্য দু'আ করেছেন। কিন্তু তাদের কারো জন্য তিনি শোক দিবস পালন করেননি।
উহুদ যুদ্ধের পর তিনি এক অঞ্চলের অধিবাসীদের দাবীর কারণে তাদেরই দ্বীনে ইসলাম শিক্ষা দেয়ার জন্য তাঁর প্রিয় সাহাবীদের মধ্য থেকে বাছাই করে শিক্ষিত সত্তর জন সাহাবীকে সে অঞ্চলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু 'বিরে মাউনা' নামক স্থানে শক্ররা আক্রমন করে তাদের সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের মাত্র একজন জীবন নিয়ে মদীনায় ফিরে এসে এ নির্মম ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। এ ঘটনায় রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এত ব্যথিত ও মর্মাহত হলেন যে, রাহমাতুললিল আলামীন হয়েও হত্যাকারীদের শাস্তি ও ধ্বংশ কামনা করে তিনি বহু দিন যাবত তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে থাকলেন। কোথায়! তিনি তো এ সকল মহান শহীদানের জন্য কোন দিবস পালন করতে নির্দেশ দিলেন না। প্রতি বছর শোক দিবস পালন করতে বললেন না।
মুতার যুদ্ধে তার তিনজন প্রিয় সেনাপতি সাহাবী শাহাদত বরণ করলেন। যায়েদ বিন হারিসা রা. জা'ফর বিন আবি তালিব রা. ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা.। আরো অনেকে। যায়েদ বিন হারেসা রা. কে আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত ভালবাসতেন। রসূলুল্লাহর ভালবাসার স্বীকৃতি হিসেবে সকলে তার উপাধি দিয়েছিল 'হিব্বু রসূলিল্লাহ'। ইসলামের দাওয়াতের শুরু থেকে তিনি সর্বদা আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে ছায়ার মত থাকতেন। আর জা'ফর বিন আবি তালিব রসূলুল্লাহর চাচাতো ভাই ছিলেন। তিনি আলী রা. এর আপন ভাই ও সাইয়েদুনা হুসাইন রা. এর আপন চাচা ছিলেন। আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা. রসূলের ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের একজন ছিলেন। তাদের শাহাদাতের খবর মদীনাতে পৌছার পর রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতখানি শোকাবিভূত হয়ে পড়েছিলেন সীরাত ও ইসলামী ইতিহাসের পাঠক তা ভালভাবে জানেন। রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি তাদের জন্য শোক দিবস চালু করেছিলেন? না প্রচলন করতে বলেছিলেন? কখনো তা করেননি।
তারা তো ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই যুদ্ধ করেই জীবন দিয়েছিলেন। এ সকল মহাপ্রাণ সাহাবীদের সাথে তাঁর যেমন ছিল আত্নীয়তার সম্পর্ক তেমনি ছিল দ্বীনে ইসলামের সম্পর্ক। কেহ বলতে পারবেন না যে তিনি তাদের কম ভালবাসতেন। তারপরও তিনি তাদের জন্য প্রতি বছর শোক পালনের ব্যবস্থা করলেন না।
এমনিভাবে রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম কতখানি ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছিলেন তা হাদীস ও ইতিহাসের কিতাবে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। তারা তো প্রতি বছর দিবস পালনের প্রথা প্রচলন করলেন না।
এরপরে উমার রা. শহীদ হলেন, উসমান রা. শহীদ হলেন, শাহাদত বরণ করলেন আলী রা.। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম কারো জন্য শোক দিবস পালন করলেন না।
কারো জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস অথবা শাহাদত দিবস পালন ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলামের কথা হল মানুষ মানুষের হ্রদয়ে বেঁচে থাকবে, ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার আমল বা কর্মের মাধ্যমে। বছরে একবার দিবস পালন করে কাউকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন নেই।
তাইতো দেখবেন কত নবী-রসূল, সাহাবা, ইমামগন, আওলিয়া, ন্যায় পরায়ন বাদশা, মনীষি রয়েছেন যাদের জন্য জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালিত হয় না। কিন্তু তারা কি মানুষের হ্রদয় থেকে বা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেছেন? না, তারা মানুষের হ্রদয় দখল করে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন।

সংকলন: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
تأليف: عبد الله شهيد عبدالرحمن
সম্পাদনা: নোমান আবুল বাশার
مراجعة: نعمان بن أبو البشر
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

No comments:

Post a Comment