Wednesday, September 26, 2018

বস্তুত: অন্তরের যিকির দুই প্রকার:



Image may contain: text and nature


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
================================
«أحب الأعمال إلى الله أن تموت ولسانك رطب من ذكر الله».
“আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল, তুমি মারা যাবে এ অবস্থায় যে তোমার জিহ্বা আল্লাহর যিকিরে থাকবে তরতাজা।[ইবন হিব্বান, ৩/৯৯; হাদীস নং ৮১৮।]”
.
আল্লামা তীবী রহ. বলেন, জবান তরতাজা রাখার অর্থ হল, জবানে অতি সহজে আল্লাহর যিকির চলতে থাকা। আর এর বিপরীতে জবান শুষ্ক থাকার অর্থ হল, মুখে যিকির বন্ধ থাকা। তারপর মুখ আল্লাহর যিকির দ্বারা সচল থাকার অর্থ হল, সবসময় আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত থাকা।
মূলত: যিকির হল, যার যিকির করা হয়, তার বিষয়ে সবসময় অন্তর সতর্ক ও সজাগ থাকা। যিকিরকে যিকির বলে নাম রাখার কারণ, যিকির অর্থ স্মরণ করা। আর মুখের যিকির অন্তরে স্মরণ করার উপর প্রমাণ বহনকারী। কিন্তু যেহেতু মুখের কথার উপর যিকিরের প্রয়োগটা অধিক, তাই মুখের যিকিরকেই যিকির বলে নাম করা হয়েছে এবং যিকির বললে আমরা সাধরণত মুখের যিকিরকেই দ্রুত বুঝি।
.
যিকির: যে সব শব্দাবলীকে অধিক পরিমাণে বলার জন্য হাদিস ও কুরআনে উৎসাহ দেয়া হয়েছে, সে সব শব্দগুলোকে বলা বা উচ্চারণ করাকে যিকির বলা হয়। যেমন, “আল-বাকীয়াতুস সালিহাত” বা স্থায়ী নেক আমলসমূহ, আর সেগুলো হচ্ছে,
.
سبحان الله، الحمد لله، ولا إله إلا الله، والله أكبر
অনুরূপ আরও যেমন, লা হাওলা..., বিসমিল্লাহ, হাসবুনাল্লাহ..., ইস্তেগফার, ইত্যাদি, এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য দোয়া করা।
.
আবার কোনো কোনো সময় ‘যিকির’ শব্দ ব্যবহার করে তার দ্বারা উদ্দেশ্য, ঐ সব নেক আমলসমূহ যেগুলোকে বান্দার উপর ওয়াজিব বা মোস্তাহাব করা হয়েছে, সেগুলোকে সবসময় চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন, কুরআন তিলাওয়াত করা, হাদিস অধ্যয়ন করা, ইলমি আলোচনা করা ও নফল সালাত আদায় করা।
যিকির অনেক সময় মুখ দ্বারা হয়ে থাকে এবং তার উপর উচ্চারণকারীকে সাওয়াব দেয়া হয়। কিন্তু শর্ত হল, তার দ্বারা যেন কেবল শব্দের অর্থই উদ্দেশ্য হয়। আর যদি উচ্চারণের সাথে অন্তরের যিকিরের সাথেও সম্পৃক্ত করা হয়, তা হলে তা হবে, অধিক পরিপূর্ণ যিকির।
.
আর যদি তার সাথে সাথে যিকির দ্বারা যিকিরকৃত শব্দগুলোর অর্থ ও যিকিরের শব্দগুলোর মধ্যে যে আল্লাহর মাহাত্ম্য ও তাঁর থেকে যাবতীয় দোষ-ত্রুটি দূরিকরণ রয়েছে তা উদ্দেশ্য হয়, তবে তার পরিপূর্ণতা আরও বেড়ে যায়। আর যদি যিকিরের শব্দাবলী কোনো নেক আমলের মধ্যে সংঘটিত হয়, তবে তার পরিপূর্ণতা আরও বৃদ্ধি পায়। আর যদি যিকিরের মধ্যে আল্লাহ সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ও ইখলাস সঠিকভাবে সম্পৃক্ত হয়, তবে তা চূড়ান্ত পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।
.
মুখের যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য- ঐসব শব্দাবলী যে সব শব্দাবলী আল্লাহর তাসবীহ-পবিত্রতা, তাহমীদ-প্রসংশা ও তামজীদ-বড়ত্ব এর প্রমাণ বহন করে।
আর অন্তরের যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য- আল্লাহর সত্ত্বা ও সিফাতসমূহের প্রমাণসমূহের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা করা, আল্লাহর তা‘আলা তার বান্দাদের যে সব আদেশ-নিষেধ করেছেন, সে আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হওয়ার উদ্দেশ্যে তাতে চিন্তা করা, আমলের বিনিময় সংক্রান্ত সংবাদগুলোর উপর চিন্তা করা এবং আল্লাহর মাখলুকাতের সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করা।
.
বস্তুত: অন্তরের যিকির দুই প্রকার:
এক. এ প্রকারের যিকির হচ্ছে, সর্বাধিক উন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ যিকির, আর তা হচ্ছে, আল্লাহর মাহাত্ম্য, শান-শওকত, ক্ষমতা, মালিকানা, ও আসমান ও যমীনে তার যে সব নিদর্শন রয়েছে সেগুলো উপলব্ধি করার জন্য নিজের চিন্তা-শক্তিকে নিয়োগ করা।
.
দুই. আদেশ নিষেধসমূহ পালনের সময় অন্তরের যিকির; আল্লাহর নিকট সাওয়াব লাভের আশায় এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচার ভয়ে, আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালন করবে এবং আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাকবে।
.
আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যিকির; আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত থাকা এবং তার আনুগত্যে ডুবে থাকা। এ কারণেই সালাতকে যিকির বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ فَٱسۡعَوۡاْ إِلَىٰ ذِكۡرِ ٱللَّهِ ٩ ﴾ [الجمعة: ٩]
“তখন তোমরা আল্লাহর স্মরনের দিকে ধাবিত হও”। [আল-জুমু‘আ, আয়াত: ৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ ذِكۡرٗا كَثِيرٗا ٤١ ﴾ [الاحزاب: ٤١]
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর”। [আল-আহযাব, আয়াত: ৪১]
.
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে আল্লাহর যিকির করা ও তার শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দেন, আরও নির্দেশ দেন যেন অধিকাংশ সময়ে তারা যাতে তাদের জিহ্বাকে আল্লাহর যিকির, তাসবীহ, তাহলীল, আল্লাহ প্রশংসা ও বড়ত্বের বর্ণনায় লিপ্ত রাখেন।
.
আল্লামা মুজাহিদ রহ. বলেন, যিকিরের শব্দগুলো এমনই যেগুলো পবিত্র, সাধারণ অপবিত্র ও বেশী অপবিত্র ব্যক্তিও বলতে পারে। তিনি আরও বলেন, একজন ব্যক্তি ততক্ষণ আল্লাহর যিকির-কারী হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় এবং শোয়া অবস্থায় আল্লাহর যিকির করবে।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র যিকির ছাড়া আর যত প্রকারের ইবাদত বান্দার উপর ফরয করেছেন, সব ইবাদতের একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করেছেন এবং অপারগতার সময় তার অপারগতাকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যিকিরের এমন কোনো সীমা নির্ধারণ করেন নি যেখানে গিয়ে বান্দা থামবে।
.
অনুরূপভাবে যিকির ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে কারও ওজরকে গ্রহণ করেন নি, যদি না তাকে ছাড়ার ব্যাপারে জোর করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ قِيَٰمٗا وَقُعُودٗا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمۡۚ ١٠٣ ﴾ [النساء: ١٠٣] “তখন দাড়ানো, বসা ও শোয়া অবস্থায় আল্লাহর স্মরণ করবে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৩] রাতে-দিনে, জলে-স্থলে, সফরে-আবাসস্থলে, প্রাচুর্য- দারিদ্রতা, অসুস্থতা-সুস্থতা. প্রকাশ্যে-গোপনে সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকির করতে হবে। যখন তোমরা তা করবে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর সালাত পেশ করবেন, (তোমাদের কথা তাঁর কাছে যারা আছে তাদের কাছে বর্ণনা করবেন) অনুরূপভাবে ফেরেশতাগণও তা করবেন।
মু‘আয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেন,
«ما شيء أنجى من عذاب الله من ذكر الله».
“আল্লাহর আযাব হতে মুক্তি দেয়ার জন্য যিকির থেকে অধিক শক্তিশালী আর কিছুই নাই”[তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৭৭।]।
আল্লাহ্ তা‘আলা যিকির শব্দটি কুরআনের অনেক আয়াতে উল্লেখ করেন। আর যিকিরকারীর জন্য ‘আল্লাহর স্মরণ করা’ আল্লাহ্ তা‘আলা তার বিনিময় বলে আখ্যায়িত করেন। একজন যিকিরকারীকে আল্লাহ স্মরণ করবে, এটি তার জন্য দুনিয়ার সব কিছু হতে উত্তম এবং দুনিয়াতে এর চেয়ে বড় কোনো আমল হতেই পারে না। আর এর মাধ্যমেই নেক আমলসমূহের পরিসমাপ্তি ঘটানোর কথা বলেছেন।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ألا أنبئكم بخير أعمالكم، وأزكاها عند مليككم، وأرفعها في درجاتكم، وخير لكم من إنفاق الذهب والورق، وخير لكم من تلقوا عدوكم فتضربوا أعناقهم، ويضربوا أعناقكم؟! قالوا: بلى! قال: ذكر الله تعالى» [أخرجه الترمذي].
“আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের জন্য সর্ব উত্তম আমলসমূহ সম্পর্কে জানিয়ে দেব? আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের মুনিবের নিকট পবিত্র আমল কোনটি তা জানিয়ে দেব? আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে, এমন আমলসমূহ সম্পর্কে জানিয়ে দেব? আমি কি তোমাদেরকে এমন আমল বাতলিয়ে দেব, যা তোমাদের জন্য স্বর্ণ মুদ্রা আল্লাহর রাহে ব্যয় করা থেকে উত্তম? আমি কি তোমাদেরকে এমন আমল বিষয়ে তোমাদের জানিয়ে দেব, যা তোমাদের জন্য দুশমনদের সাথে মুখোমুখি হয়ে তোমরা তাদের হত্যা করবে এবং তারা তোমাদের হত্যা করবে তা হতে উত্তম? সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ! তিনি বললেন, তা হল, আল্লাহ তা‘আলার যিকির”[তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৭৭।]। [তিরমিযি]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
«أحب الكلام إلي الله أربع؛ سبحان الله، والحمد لله، ولا إله إلا الله، والله أكبر؛ لا يضرك بأيهن بدأت» [أخرجه مسلم].
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় কালাম চারটি। এক- সুবহানাআল্লাহ দুই- আলহামদু লিল্লাহ-তিন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ চার-আল্লাহু আকবর। যেটি দিয়েই শুরু কর, তাতে কোন অসুবিধা নাই”[মুসলিম, হাদীস নং ২১৩৭।]। [মুসলিম]
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর উপকারিতা: বলা হয়ে থাকে যে, এ কালিমার মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য আছে:
এক. এ কালেমার মধ্যে যতটি শব্দ আছে সব কটি শব্দ ‘হুরুফে জাওফিয়া’ অর্থাৎ শব্দগুলোর উচ্চারণের স্থান হল, মুখের মধ্যখান যাকে পেট বলা হয়। এ কালেমার মধ্যে এমন কোনো শব্দ নেই যে শব্দের উচ্চারণের স্থান ঠোট ব্যবহার করতে হয়, যেমন ‘বা’, ‘মিম’, ‘ফা’, ইত্যাদি। এ দ্বারা ইশারা করা হল, এ কালেমা মানুষ যেন শুধু ঠোটে বা মুখে উচ্চারণ না করে বরং পেট-অন্তর-থেকে উচ্চারণ করে, শুধু ঠোটে -মুখে- উচ্চারণ যথেষ্ট নয়।
দুই. এ কালেমার মধ্যে নুকতা বিশিষ্ট কোন শব্দ নাই; বরং সবকটি হরফ বা শব্দ নুকতা হতে খালি। এ দ্বারা উদ্দেশ্য এ কথার দিক ইশারা করা, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নাই। এ কালেমা আল্লাহ ছাড়া যত মা‘বুদ আছে সমস্ত মা‘বুদ হতে খালি।

No comments:

Post a Comment