Thursday, September 1, 2016

ফাজায়েলে হজ্জ- মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি কর্তৃক লিখিত হজ্জ বিনষ্টকারী এক কিতাবঃ





প্রখ্যাত দেওবন্দী আলেম মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ একজন আলেম। উপমহাদেশে তার উপাধি শাইখুল হাদীস। তিনি বেশ কিছু কিতাব লিখেছেন। বিশেষ করে তার লিখিত কিতাবগুলো দেওবন্দীদের দাওয়াতি শাখা হিসাবে পরিচিত প্রচলিত তাবলীগ জামা’আতের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, ফাজায়েলে আমল, ফাজায়েলে সাদাকাত, ফাজায়েলে দরূদ, ফাজায়েলে হজ্জ ইত্যাদি।

প্রতি বছর হজের মৌসুমে মসজিদে মসজিদে এই কিতাবের তালিম দেয়া হয়। হজের মৌসুম ছাড়া অন্য কোন সময় এই কিতাবের তালিম হয় না বললেই চলে। আর যারা হজ করতে ইছুক তাদের সবাইকে হজ্জের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মনোযোগ দিয়ে এই কিতাব পাঠ করতে বলা হয়।
কিতাবগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। উল্লেখিত কিতাবগুলোতে কিছু কুরআনের আয়াত ও কিছু বিশুদ্ধ হাদীসের পাশাপাশি অসংখ্য যইফ ও জাল বর্ণনা রয়েছে। কিতাবগুলোতে যইফ ও জাল বর্ণনা ছাড়াও অসংখ্য শিরক ও বিদা’আত এবং আজগুবি ও ঈমান বিধ্বংসী কিসসা কাহিনী বিদ্যমান। কোন ব্যক্তি যদি এই কিতাবের বক্তব্যগুলো বিশ্বাস করে ও সেই অনুযায়ী আমল করে তাহলে নিঃসন্দেহে সে মুশরিকে পরিনত হয়ে যাবে।
হজ্জ মুলত আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহীদের শিক্ষা দেয়। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাঁর নবুয়তী জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় বাতিল মাবুদকে পরিহার করে শুধুমাত্র এক আল্লাহর উপাসনা করার দাওয়াত দিয়েছিলেন। তৎকালীন মক্কার মুশরিকদের সাথে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-এর মুল বিরোধই ছিল এই একত্ববাদকে কেন্দ্র করে। মক্কার মুশরিকেরা আল্লাহর পাশাপাশি অন্যান্য বাতিল মাবুদের ইবাদত করত, তাদের কাছে সাহায্য চাইত, তাদের কাছে সুপারিশ কামনা করত ও তাদের কাছেই দু'আ করত।
অথচ দু'আ করা ইসলামের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। দু'আ করা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই। সংক্ষেপে আমরা শুধু এটুকু বলছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দু'আ করা শিরকে আকবর।
ফাজায়েলে হজ্জ কিতাবটি মুলত হজ্জের ফযিলত সম্পর্কে লেখা হয়েছে। সেখানে হজ্জের ফযিলতের পাশাপাশি রাসুল (সাঃ) এর কবর সম্পর্কেও তাদের আকিদা বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে। মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেবের লেখনি থেকে আমরা যা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিঃ
১) তিনি রাসুল (সাঃ) এর কবর জিয়ারতকে এতো গুরুত্ব দিয়েছেন, যেন তা হজ্জের রুকন অথবা ওয়াজিব পর্যায়ের একটি কাজ।
২) তিনি বিশ্বাস করেন যে, রাসুল (সাঃ) এর হায়াত ও মউতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
৩) তিনি সরাসরি রাসুল (সাঃ) এর কবরের কাছে সাহায্য প্রার্থনা, তাঁর কাছে দু’আ করা ইত্যাদি সমর্থন করেন। এবং বিশ্বাস করেন রাসুল (সাঃ) কবর থেকে মানুষের অভাব-অভিযোগ ও দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করেন ও তার প্রতিকার করার ক্ষমতা রাখেন।
৪) রাসুল (সাঃ) ছাড়াও সাহাবী ও বিভিন্ন নেককার ব্যক্তিদের কবরে সাহায্য প্রার্থনা জায়েজ মনে করেন এবং মৃত ব্যক্তিরা জীবিতদের আহবানে সাড়া দেয় ও উপকার করার ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস রাখেন।
উপরোক্ত চারটি আকিদা বিশ্বাস ও আমল আহলে সুন্নাহর আকিদা বিশ্বাসের সাথে শুধু সাঙ্ঘরসিক নয় বরং কুফরী ও শিরকে আকবর যা একজন মুসলিমকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়।এছাড়া হজের সাথে মদিনা জিয়ারতের কোনো সম্পর্ক নেই।
নিম্নে প্রথমে আমরা দেখাবো মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব তার 'ফাজায়েলে হজ' নামক কিতাবে কিভাবে রাসুল (সাঃ) এর কবরে সাহায্য চাওয়াকে উৎসাহিত করেছেন। অতঃপর সাহাবীদের ও অন্যান্য নেককার ব্যক্তিদের কবরে সাহায্য কামনা করার বিষয়ে উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ। সম্মানিত পাঠকদের ধৈর্য সহকারে পাঠ করার ও অনুধাবন করার অনুরোধ করছি।
রাসুল (সাঃ) এর কবর জিয়ারতের আদব সম্পর্কে মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব যা উল্লেখ করেছেনঃ
“দৃষ্টি নীচের দিকে রাখিবে, সেখানে এদিক সেদিক দেখা শক্ত বেয়াদবী। হাত পা খুব নীরব নিস্তব্ধ থাকিবে এবং মনে করিবে, হুজুরের চেহারা মোবারক এখন আমার সম্মুখে। আমি যে হাজির তাহা হুজুর (সাঃ) জানেন। মনে করিবে যেন, আমি হুজুরের জীবিতাবস্থায় তাহাঁর দরবারে হাজির হইয়াছি। কেননা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার ব্যাপারে সেই সময় হুজুরের হায়াত এবং মউতের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না।” ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৩৭
নোটঃ যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব বিশ্বাস করেন রাসুল (সাঃ) এর জীবন ও মরনের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই, এবং তিনি গায়েব জানেন। এটা আহলে সুন্নাহর আকিদা নয়।
রাসুল (সাঃ) এর কাছে দু’আ করার সময় তাঁর কবরের দিকে পিঠ দেয়া যাবে নাঃ
“দোআ করার সময় মুখ হুজুরের চেহারা মোবারকের দিকে থাকিতে হইবে। যদিও অন্যান্য দোআর সময় চেহারা কেবলার দিকে রাখিতে হয়। কেননা এখানে কেবলার দিকে ফিরিলে হুজুর (সাঃ) পিছনে হইয়া যান, যাহা আদবের খেলাফ। তাই হুজুরের দিকে মুখ করিয়া দোআ করিবে।’’ ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৪৩
নোটঃ বর্তমান সময়ে বিভিন্ন মাজারে এই দৃশ্য দেখা যায়। মাজার জিয়ারতকারীরা জিয়ারত শেষে উল্টো ভাবে (অর্থাৎ মাজারের দিকে পিঠ না দিয়ে বরং চেহারা ও বুক মাজারের দিকে) বের হয়ে আসেন। এবং এটা তারা সম্মান বা তাজিমের জন্যই করেন অথবা বিশ্বাস করেন এভাবে সম্মান না দেখালে কবরস্থ ব্যক্তি রাগান্বিত হয়ে তার ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন।
এই বিশ্বাসের সাথে ইসলামি শিষ্টাচারের সামান্যতম কোনো সম্পর্ক নেই। দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও মানুষ মুহাম্মাদ (সাঃ) কে জীবিত অবস্থায় কোনো সাহাবী এভাবে সম্মান জানিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। আর তাঁর মৃত্যুর পরও আদব হিসাবে কেউ এমনটি করেছেন বলে আমরা জানি না।
তাছাড়া হাদীসে রাসুল (সাঃ) উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় স্থান মসজিদ। আর মসজিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ হল বাইতুল্লাহ। সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান কাবা থেকেও কেউ এভাবে বের হয় না।
সুতরাং, আমরা মনে করি, মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি কবর জিয়ারতের আদব সম্পর্কে যা উল্লেখ করেছেন তা ইসলামী শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং পরোক্ষভাবে কবর পুজার দিকেই মানুষকে ধাবিত করে।
রাসুল (সাঃ) এর কবরে সুপারিশ কামনার শিরকঃ
ঘটনাঃ ১
ছালামের পর হুজুরের উছিলায় আল্লাহ পাকের দরবারে দোআ করিবে এবং হুজুরের নিকট সুপারিশের জন্য দরখাস্ত করিবে। ফাজায়েলে হজ্জ পৃষ্ঠা নঃ ১৪০

ঘটনাঃ ২ 
ছালামের পর এইভাবে দোআ করিবে, হে আল্লাহর নবী! আমি আপনার নিকট সুপারিশ চাই এবং এই প্রার্থনা করি যেন আমার মৃত্যু হয় আপনার দ্বীনের উপর ও আপনার ছুন্নতের উপর। ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৪১

ঘটনাঃ ৩ 
অন্য কেহ হুজুরের খেদমতে ছালাম বলিবার হুকুম করিয়া থাকিলে এইভাবে ছালামে আরজ করিবে, হে আল্লাহর নবী! অমুকের বেটা অমুকের তরফ হইতে আপনার উপর ছালাম। সে আপনার দরবারে আল্লাহ পাকের নিকট সুপারিশ চাহিতেছে’’ ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৪৩

নোটঃ এখানে দেখা যাচ্ছে যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব সরাসরি রাসুল (সাঃ) এর কাছেই সুপারিশ কামনা করছেন। যা সুস্পষ্ট শিরক। রাসুল (সাঃ) সুপারিশ করবেন এটা সত্য, তবে তিনি সুপারিশের মালিক নন। আর তিনি নিজের ইচ্ছানুযায়ী সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখেন না। সুপারিশের মালিক একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা। তিনি যার জন্য ইচ্ছা করবেন শুধুমাত্র তার জন্যই রাসুল (সাঃ) সুপারিশ করতে পারবেন। সুতরাং সুপারিশ চাইতে হবে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে। এটাই আহলে সুন্নাহর আকিদা।
স্বয়ং অনুবাদকও রাসুল (সাঃ) এর নিকট সুপারিশ কামনার শিরকে লিপ্ত হয়েছেনঃ
ফাজায়েলে হজের অনুবাদক মাওলানা ছাখাওয়াত উল্লাহ রাসুল (সাঃ) এর কবরে নিজের জন্য রাসুল (সাঃ) এর কাছে সুপারিশ কামনা করেছেন। তিনি বলেনঃ
“যাহারা আমার এই বাংলা অনুবাদখানা পড়িবেন তাহাদের খেদমতে নালায়েক পাপী গোনাহগারের সবিনয় ও করজোড় আবেদন, সেই মোবারক সময়ে এই অধম খাকছারের কথা যদি আপনার মনে আসিয়া যায় তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার প্রিয় নবীজীর খেদমতে আরজ করিবেন, বড়ই এহছান হইবে। যদি আরবী শব্দ মনে না থাকে তবে উর্দু অথবা বাংলাতেই হুজুরের দরবারে আমার ছালামখানি এই বলিয়া পৌঁছাইয়া দিবেন যে, ইয়া রাসুলুল্লাহ! ছোলতান আহমদের বেটা ছাখাওয়াত উল্লাহ আপনার খেদমতে ছালাম পৌঁছাইতেছে এবং আপনার পরওয়ারদেগারের নিকট আপনার সুপারিশ চাহিতেছে।” ফাজায়েলে হজ্জ, পৃষ্ঠা নঃ ১৪৩-১৪৪

নোটঃ মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেবের বইটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদক মাওলানা ছাখাওয়াত উল্লাহ সাহেব যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেবের আকিদা বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেও এই শিরকে লিপ্ত হয়েছেন।
সাহাবীদের কবরের নিকট সুপারিশ কামনার শিরকঃ
হজরত ছিদ্দিক (রাঃ) এবং ওমর ফারুক (রাঃ) এর উপর ছালাম পড়ার পর উভয়ের কবরের মাঝখানে দণ্ডায়মান হইয়া দুইজনকে লক্ষ্য করিয়া একত্রে এইভাবে ছালাম পড়িবেঃ ‘’রাসুলুল্লাহর পাশে শায়িত হে ছাহাবীদ্বয়! আল্লাহ তায়ালা আমাদের তরফ হইতে আপনাদিগকে উপযুক্ত প্রতিদান দিন।
আমরা আপনাদের খেদমতে এই জন্য হাজির হইয়াছি যে, আপনারা হুজুরে পাক (সাঃ) এর দরবারে আমাদের জন্য এই বলিয়া দরখাস্ত করিবেন যেন তিনি আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশ করেন। যেন আল্লাহ আমাদিগকে হুজুরের দ্বীনের উপর, তাঁহার ছুন্নতের উপর জিন্দা রাখেন এবং আমাদের সমস্ত মুসলমানের হাশর যেন হুজুরে পাক (সাঃ) এর জমাতের মধ্যে হয়’’ ফাজায়েলে হজ্জ, পৃষ্ঠা নঃ ১৪৫
নোটঃ মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব শুধু রাসুল (সাঃ) এর কবরে সাহায্য চাওয়াকে বৈধ মনে করেন না, বরং সাহাবীদের কবরেও সাহায্য কামনা করা যায়- এই শিরকি আকিদা বিশ্বাস লালন করেন।
উপরেল্লিখিত বিষয়গুলো পরকালীন- যেমন ‘সুপারিশ চাওয়া’। নিম্নে আমরা দেখাবো ইহকালীন বিপদাপদ যেমন অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি থেকে পরিত্রান লাভের আশায় রাসুল (সাঃ) এর কবরে সাহায্য প্রার্থনার শিরক। ‘ফাজায়েল হজ্জ’ কিতাব থেকে সামান্য কয়েকটি নমুনা উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি ইন শা আল্লাহ।
মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব বিশ্বাস করেন, ক্ষুধায় কাতর ব্যক্তি রাসুল (সাঃ) এর কবরে উপস্থিত হয়ে খাবার প্রার্থনা করলে রাসুল (সাঃ) তাদের আহবানে সাড়া দেনঃ
ঘটনাঃ ১ 
রাসুল (সাঃ) এর কবরে খাবার প্রার্থনার শিরকঃ অতঃপর কবর হতে রুটি দানঃ
শায়েখ আবুল খায়ের (রহঃ) বলেন, একবার মদীনা মোনাওয়ারায় হাজির হইয়া পাঁচ দিন পর্যন্ত আমাকে উপবাস থাকিতে হয়। খাওয়ার জন্য কিছুই না পাইয়া অবশেষে আমি হুজুরের এবং শায়খাইনের কবরের মধ্যে ছালাম পড়িয়া আরজ করিলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি আজ রাত্রে হুজুরের মেহমান হইব। এই কথা আরজ করিয়া মিম্বর শরীফের নিকট গিয়া আমি শুইয়া পড়িলাম, স্বপ্নে দেখি হুজুর পাক (সাঃ) তশরীফ আনিয়াছেন, ডানে হজরত আবু বকর, বাম দিকে হজরত ওমর এবং সামনে আলী (রাঃ)। হজরত আলী (রাঃ) আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, এই দেখ, হুজুর (সাঃ) তাশরীফ আনিয়াছেন। আমি উঠিবা মাত্রই হুজুর (সাঃ) আমাকে একটা রুটি দিলেন, আমি উহার অর্ধেক খাইয়া ফেলি। তারপর যখন চোখ খুলিল তখন আমার হাতে বাকী অর্ধেক ছিল। ফাজায়েলে হজ,পৃষ্ঠা নঃ ১৫৫

ঘটনাঃ ২ 
ক্ষুধার কষ্ট দূর করার জন্য রাসুল (সাঃ) এর কবরে সাহায্য প্রার্থনার শিরকঃ অতঃপর কবর হতে খাবারের ব্যবস্থাঃ

আবু বকর ইবন মুকরী বলেন, আমি, ইমাম তিবরানী এবং আবু শায়েখ মদীনা শরীফে ক্ষুধায় বড় কষ্ট পাইতেছিলাম। রোজার উপর রোজা রাখিতাম। রাত্রি বেলায় হুজুরের কবর শরীফে গিয়া ক্ষুধার অভিযোগ করিলাম। ফিরিবার সময় তিবরানী বলেন, বসিয়া পড়, হয় কিছু খানা আসিবে না হয় মৃত্যু আসিবে। এবনে মোনকাদের বলেন, আমি এবং আবু শায়েখ দাঁড়াইয়া গেলাম। তিবরানী বসিয়া কি যেন চিন্তা করিতেছিলেন। হঠাৎ একজন আলাভী দরজা নাড়া দেয়। আমরা দরজা খুলিয়া দিলাম, দেখিলাম তাহার সহিত দুইজন গোলাম। তাহাদের হাতে বড় বড় দুইটি থলিয়া। থলিয়া দুইটি রাখিয়া আলাভী বলিয়া গেলেন, তোমরা হুজুরের নিকট অভিযোগ করিয়াছ। আমি স্বপ্নযোগে হুজুর (সঃ) হইতে তোমাদের নিকট কিছু পৌঁছাইবার আদেশ পাইয়াছি। ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৬১
ঘটনাঃ ৩
রাসুল (সাঃ) এর কবরে মেহমান হওয়ার আকাঙ্ক্ষাঃ অতঃপর কবর হতে রুটি প্রদানঃ

এবনে জালা (রঃ) বলেন, আমি মদীনা মোনাওয়ারায় বড় অভাবের সম্মুখিন হইয়াছিলাম। হুজুরের কবরের নিকট গিয়া আরজ করিলাম, হুজুর! আমি আপনার মেহমান! ইত্যবসরে আমার একটু চোখ লাগিয়া আসিল। হুজুর (সঃ) আমাকে একটা রুটি দিলেন, আমি উহার অর্ধেক খাইলাম। জাগ্রত হইয়া দেখি বাকী অর্ধেক আমার হাতে। ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৬১
ঘটনাঃ ৪ 
ছারিদ খাওয়ার জন্য রাসুল (সাঃ) এর কবরে প্রার্থনাঃ অতঃপর কবর হতে খাবারের ব্যাবস্থাঃ

ছাইয়েদ আবু মোহাম্মদ হোছাইনী বলেন, আমি মদীনা শরীফে তিন দিন পর্যন্ত ভুখা ছিলাম। অতঃপর মিম্বর শরীফের নিকট গিয়া দুই রাকাত নামাজ পড়িয়া হুজুরের দরবারে আরজ করিলাম, দাদাজান! আমি ভুখা আছি এবং ছরীদ খাইতে আমার দিল চায়। তারপর আমি শুইয়া পড়িলাম। ক্ষণেক পর এক লোক আসিয়া আমাকে জাগাইল এবং একটি পেয়ালায় করিয়া ছরীদ পেশ করিল, যেখানে খুব গোশত, ঘি এবং খোশবু ছিল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ইহা কোথা হইতে আসিয়াছে? সে বলিল, আমার সন্তানগণ তিন দিন পর্যন্ত ইহা খাইতে চায়। অবশেষে আল্লাহ পাক ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। আমি উহা পাক করিয়া শুইয়া পড়ি। খাবে আমার নবীজীকে দেখিতে পাই, তিনি বলিতেছেন, মসজিদে তোমার এক ভাই ছরীদ খাইতে চায়, তাহাকেও কিছু দিয়া দাও। ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৬২-১৬৩
ঘটনাঃ ৫ 
ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাসুল (সাঃ) এর নিকট খাদ্যের আবেদনঃ অতঃপর খাদ্যের ব্যবস্থাঃ

আবুল আব্বাছ এবনে মুকরী অন্ধ ছিলেন। তিনি বলে, আমি তিন দিন পর্যন্ত মদীনা শরীফে ভুখা অবস্থায় ছিলাম। অবশেষে হুজরা শরীফের নিকট নিবেদন করিলাম, হুজুর! আমি ভুখা। ইহার পর দুর্বল অবস্থায় শুইয়া পড়িলাম। এমতাবস্থায় একটি মেয়ে আসিয়া পা দ্বারা আমাকে জাগাইয়া তাহার ঘরে লইয়া গেল এবং আটার রুটি, ঘি ও খেজুর খাইতে দিল। মেয়েটি বলিল, আবুল আব্বাছ খাও। আমার দাদাজান (অর্থাৎ রাসুল) তোমাকে খাওয়াইতে বলিয়াছেন, যখনই ক্ষুধা পাইবে আমাদের এখানে আসিয়া খাইয়া যাইও। ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৬৩-১৬৪
অভাব-দুর্ভিক্ষ দূর করার জন্য রাসুল (সাঃ) এর কবরে সাহায্য প্রার্থনার শিরকঃ
হজরত ওমরের জামানায় একবার মদীনা শরীফে ভীষণ অভাব দেখা দিয়াছিল। জনৈক ব্যক্তি হুজুর পাক (সাঃ) এর কবর শরীফে হাজির হইয়া আরজ করিল, ইয়া রাছুলুল্লাহ! আপনার উম্মত ধ্বংস হইয়া যাইতেছে, বৃষ্টির জন্য দু’আ করুন। ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৬০
অভাবগ্রস্ত হয়ে রাসুল (সাঃ) এর কবরে সাহায্য প্রার্থনার শিরকঃ অতঃপর মুদ্রা প্রাপ্তিঃ
ছুফী আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বিন আবী জারআ বলেন, আমি একবার আমার পিতার সঙ্গে মক্কা শরীফে যাই। আমরা ভীষণ অভাবগ্রস্ত ছিলাম। ঐ অবস্থায় মদীনা শরীফ চলিয়া যাই। রাত্রি বেলায় ক্ষুধায় ছটফট করিতে থাকি। আমি নাবালেগ ছিলাম, বারংবার পিতার নিকট ক্ষুধার কথা বলিতে থাকি। আমার পিতা কবর শরীফের নিকট গিয়া বলিলেন, হুজুর আমরা আজ আপনার মেহমান। এই বলিয়া তিনি মোরাকাবায় বসিয়া গেলেন। অনেকক্ষণ পর তিনি মাথা উঠাইয়া কখনো কাদিতে এবং কখনো হাসিতে লাগিলেন। লোকেরা ইহার কারন জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি বলিলেন, আমার হুজুরের জেয়ারত নছীব হইয়াছে। হুজুর (সঃ) আমাকে কিছু দেরহাম দান করিয়াছেন। দেখা গেল, তাহার হাতে অনেকগুলি দেরহাম রহিয়াছে। ছুফীজী বলে, আল্লাহ পাক উহাতে এত বরকত দান করিয়াছেন যে, শিরাজে ফিরিয়া যাওয়া পর্যন্ত আমরা উহা হইতে খরচ করিতে থাকি। ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৬১-১৬২
শুধু জাগ্রত অবস্থায় নয়, স্বপ্নের মধ্যেও রাসুল (সাঃ)-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনাঃ অতঃপর সত্যি সত্যি দিরহাম প্রাপ্তি!
শায়েখ আহমদ বলেন, আমি তের মাস পর্যন্ত ময়দানে জঙ্গলে পেরেশান হইয়া ফিরিতে থাকি। ইহাতে আমার শরীরের চামড়া পর্যন্ত খসিয়া যায়। অবশেষে হুজুর ও শায়খাইনের খেদমতে ছালাম করিতে যাই। রাত্রি বেলায় হুজুর স্বপ্নে আমাকে বলেন, আহমদ! তুমি আসিয়াছ। আমি বলিলাম, হুজুর আমি আসিয়াছি। আমি বড় ক্ষুধার্ত, আমি হুজুরের মেহমান। হুজুর (সঃ) বলিলেন, দুই হাত খোল। আমি দুই হাত খুলিলে দেরহাম দিয়া ভর্তি করিয়া দিলেন। জাগ্রত হইয়া দেখি, আমার হাত দেরহামে ভর্তি। আমি উহা দ্বারা কিছু খাইয়া আবার জঙ্গলের দিকে রওয়ানা হইলাম’ ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৬২
কষ্ট থেকে পরিত্রান লাভের জন্য রাসুল (সাঃ)-এর কবরে সাহায্য প্রার্থনার শিরকঃ অতঃপর কবর হতে সাহায্য লাভঃ
ইউছুফ বিন আলী বলেন, জনৈক হাশেমী মেয়েলোক মদীনায় বাস করিত। তাহার কয়েকজন খাদেম তাহাকে বড়ই কষ্ট দিত। সে হুজুরের দরবারে ফরিয়াদ লইয়া হাজির হইল। রওজা শরীফ হইতে আওয়াজ আসিল, তোমার মধ্যে কি আমার আদর্শের প্রতি আনুগত্যের আগ্রহ নাই? তুমি ছবর করো, যেমন আমি ছবর করিয়াছিলাম। মেয়েলোকটি বলেন, এই সান্তনাবানী শুনিয়া আমার যাবতীয় দুঃখ মুছিয়া গেল। ঐদিকে বদ আখলাক খাদেমগুলি মরিয়া গেল। ফাজায়েলে হজ,পৃষ্ঠা নঃ ১৫৯
অন্যায়ভাবে প্রহৃত এক ব্যক্তির রাসুল (সাঃ) এর নিকট অভিযোগ পেশঃ অতঃপর বিচারঃ
ছাবেত বিন আহমদ বলেন, তিনি একজন মোয়াজ্জেনকে মসজিদে নববীতে আজান দিতে দেখিয়াছিলেন। মোয়াজ্জেন যখন আচ্ছালাতু খায়রুম মিন্নাওম বলিল, তখন এক খাদেম আসিয়া তাহাকে একটি থাপ্পর মারিল। মোয়াজ্জেন কাঁদিয়া উঠিয়া আরজ করিল, ইয়া রাছুলুল্লাহ! আপনার উপস্থিতিতে আমার এইরুপ হইতেছে? সঙ্গে সঙ্গে সেই খাদেমের শরীর অবশ হইয়া গেল। লোকজন তাহাকে উঠাইয়া ঘরে লইয়া গেল এবং তিন দিন পর সে মরিয়া গেল। ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৬২
নিজের দেশে ফেরার জন্য রাসুল (সাঃ)-এর কবরে সাহায্য প্রার্থনাঃ অতঃপর নিজের দেশে গমনঃ
শায়েখ আবদুছ ছালাম বিন আবিল কাছেম বলে, আমার নিকট এক ব্যক্তি বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেন, আমি মদীনা শরীফে উপস্থিত ছিলাম। আমার নিকট খাওয়ার মত কিছুই ছিল না। ইহাতে আমি খুব দুর্বল হইয়া গেলাম এবং হুজুরের খেদমতে আরজ করিলাম, হে দোজাহানের সর্দার! আমি মিসরের বাসিন্দা, পাঁচ মাস যাবৎ হুজুরের খেদমতে পড়িয়া আছি। এখন আল্লাহর নিকট এবং আপনার খেদমতে আরজ করিতছি যে, এমন একজন লোক ঠিক করিয়া দিন, যে আমার খাওয়ার খবর নিবে অথবা আমার দেশে ফিরিবার এন্তেজাম করিয়া দিন।
হঠাৎ একজন লোক হুজরা শরীফের নিকট আসিয়া কি যেন বলিয়া অবশেষে আমার নিকট আসিয়া আমার হাত ধরিয়া বলিল, আমার সহিত চল। সে আমাকে লইয়া বাবে জিব্রিল দিয়া বাহির হইয়া জান্নাতুল বাকীর উপর দিয়া একটি তাঁবুর মধ্যে লইয়া গেল। সেখানে নিয়া খানা পাকাইয়া আমাকে খুব তৃপ্তির সহিত খাওয়াইল। পরে সে দুইটি থলিয়ার মধ্যে প্রায় সাত সের পরিমান খেজুর দিয়া আমাকে বলিল, তোমাকে কছম দিয়া বলিতেছি, দাদা আব্বার (অর্থাৎ রাসুলের) নিকট তুমি আর অভিযোগ করিবে না, ইহাতে তাঁহার খুব কষ্ট হয়। যখনই তোমার খানা শেষ হইয়া যাইবে তোমার নিকট আবার নতুন খানা পৌঁছাইয়া যাইবে। এই বলিয়া সে খেজুরের থলিয়া আপন গোলামকে হুজরা শরীফ পর্যন্ত দিয়া আসিতে বলে। আমি চার দিন পর্যন্ত উহা হইতে খাইতে থাকি। তাহা শেষ হওয়ার পর সেই গোলাম আবার খানা পৌঁছাইয়া দেয়। এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর ইয়াম্বুগামী একটি কাফেলার সহিত আমি তথায় চলিয়া যাই। ফাজায়েলে হজ,পৃষ্ঠা নঃ ১৬৩
রাসুল (সাঃ) এর কবরে সুস্থতার জন্য পত্রপাঠঃ অতঃপর রোগীর আরোগ্য লাভঃ
বর্ণিত আছে, গ্রানাডার এক ব্যক্তি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। ডাক্তারগন পর্যন্ত নিরাশ হইয়া তাহার জীবনের আশা ত্যাগ করেন। উজীর আবদুল্লাহ কয়েকটি বয়াতসহ তাহাকে হুজুর (ছঃ)-এর খেদমতে একটি পত্র লিখিয়া হাজীদের কাফেলার সাথে পাঠাইয়া দেয়। লোকটির স্বাস্থ্যের জন্য যখন ঐ পত্রটি হুজুরের কবর শরীফের নিকট পড়া হয়, তখনই সে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করিয়া ভালো হইয়া যায়। ফাজায়েলে হজ, পৃষ্ঠা নঃ ১৬৬
কবর থেকে হাত বের করার জন্য রাসুল (সাঃ) এর কাছে দু’আ করা, যেন তাঁর হাতে চুম্বন করার ইচ্ছা পুরন হয়ঃ অতঃপর কবর হতে হাত বের হওয়াঃ
বিখ্যাত ছুফী ও বুজুর্গ শায়েখ আহমদ রেফায়ী (রঃ) ৫৫৫ হিজরী সনে হজ সমাপন করিয়া জেয়ারতের জন্য মদীনায় হাজির হন। তিনি কবর শরীফের সামনে দাঁড়াইয়া এই দুইটা বয়াত পড়েন- ‘দূরে থাকা অবস্থায় আমি আমার রুহকে হুজুরের খেদমতে পাঠাইয়া দিতাম, সে আমার নায়েব হইয়া আস্তানা শরীফে চুম্বন করিত। আমি আজ সশরীরে দরবার হাজির হইয়াছি। কাজেই হুজুর আপন দস্ত মোবারক বাড়াইয়া দিন যেন আমার ঠোঁট তাহা চুম্বন করিয়া তৃপ্তি হাছেল করিতে পারি।’
বয়াত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবর শরীফ হইতে হাত মোবারক বাহির হইয়া আসে এবং হজরত রেফায়ী (রঃ) তাহা চুম্বন করিয়া ধন্য হন। বলা হয়, সেই সময় মসজিদে নববীতে নব্বই হাজার লোকের সমাগম ছিল। সকলেই বিদ্যুতের মত হাত মোবারকের চমক দেখিতে পায়। তাহাদের মধ্যে মাহবুবে ছোবহানী হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)-ও ছিলেন। ফাজায়েলে হজ,পৃষ্ঠা নঃ ১৫৮
নোটঃ মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেবের উল্লেখিত বক্তব্য সমুহ থেকে প্রমানিত হয় যে, তিনি বিশ্বাস করেন, রাসুল (সাঃ) তাঁর মৃত্যুর পর উম্মাহর অবস্থা সম্পর্কে সচেতন, তাঁর কাছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বিষয়ে সাহায্য কামনা করা যায়েজ এবং তিনি কবর থেকে ডাকে সাড়া দেন এবং বিপদাপদে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, এগুলো আকিদা বিশ্বাস নিঃসন্দেহে একজন মুসলিমকে মুশরিক বানিয়ে দেয়। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে শিরক থেকে হেফাযত করুন, তাওহীদের উপর অটল রাখুন। আমাদের হজকে কবুল করুন, ও আমাদের সবাইকে শিরকি কিতাব থেকে হেফাযত করুন।

No comments:

Post a Comment