Thursday, November 30, 2017

আপনার সন্তানকে সালাতের নির্দেশ দিন:



Image may contain: one or more people and text

আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে আমি বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। ইমাম তথা জনতার নেতা একজন দায়িত্বশীল; তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের; সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। স্ত্রী দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহ ও সন্তানের; সে জিজ্ঞাসিত হবে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে। মানুষের (দাস) ভৃত্য দায়িত্বশীল মুনিবের সম্পদের, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার মুনিবের সম্পদ সম্পর্কে। অতএব, সতর্ক থেকো, তোমরা সবাই দায়িত্বশীল আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে।’ 📚(বুখারী:৭১৩৮; মুসলিম:৪৮২৮; আবূ দাউদ:২৯৩০)
🔶 ইমাম নববী (রহ.) বলেন, তিনিই পূর্ণ ‘দায়িত্বশীল’, যিনি রক্ষণাবেক্ষণকারী, বিশ্বস্ত, নিজ দায়িত্ব ও নজরাধীন বিষয়ের কল্যাণ ও স্বার্থ সম্পর্কে সজাগ। এ থেকেই বুঝা যায়, তার নজরাধীন যত বিষয় রয়েছে, তার কাছে সে বিষয়ে ইনসাফ কাম্য। তার দুনিয়া ও আখিরাত এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কল্যাণ কাম্য।
আজকাল অনেক বাবা-মাই মনে করেন সন্তানের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা পর্যন্তই তাদের দায়িত্ব সীমিত। কখনো খেলাধুলা ও বস্তুগত আরও কিছুকে এর সঙ্গে যোগ করা হয়। অথচ তারা তাদের সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারেন না। কারণ তাদের গুরুত্বের সবটুকু জুড়ে থাকে শারীরিক প্রতিপালন, কখনো বুদ্ধিবৃত্তিক লালনকেও এর সঙ্গে যোগ করা হয়। তবে রুহ তথা আত্মার খোরাক সম্পর্কে উদাসীনতা দেখানো হয়। অথচ বাস্তবে মানুষ প্রথমে রূহ, তারপর বুদ্ধি অতপর দেহ।
সন্তানকে দুনিয়াদারির সঙ্গে সঙ্গে আখিরাতের প্রস্তুতির শিক্ষা দিতে হবে। জাগতিক সব শিক্ষা-দীক্ষার পাশাপাশি পারলৌকিক জ্ঞানও দিতে হবে। শরীয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকামের ইলম শেখাতে হবে। শুধু ধারণা দেয়াই যথেষ্ট নয়; সার্বিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে তার অনুশীলনও করাতে হবে। মৌলিক দীনী জ্ঞান এবং আমল-ইবাদত শেখাতে হবে। আর ঈমানের পর সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক চর্চিত আমল হলো সালাত। সন্তানকে তাই সালাত আদায় করা শেখাতে হবে। শিক্ষা দিতে হবে সালাত আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ইলম।
সালাতের অপরিসীম গুরুত্বের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৈশব-কৈশোর থেকেই সন্তানকে সালাতে অভ্যস্ত করাতে বলেছেন। অথচ সাধারণ মুসলিমরা তো দূরের কথা, আমরা যারা নিয়মিত সালাত আদায় করি, শরীয়তের গণ্ডির মধ্যে থেকে জীবন যাপনের চেষ্টা করি, তারাও এ ব্যাপারে কর্তব্যে অবহেলা করি। নিজে ঘুম থেকে জেগে ফজরের সালাত আদায় করতে মসজিদে যাই অথচ পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা সন্তানকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে যাই না।
অনেকে সন্তানের ঘুম ভাঙ্গানোকে ভালোবাসার অন্তরায় ভেবে এ ব্যাপারে উদাসীনতা দেখান। তারা কি জানেন, সাহাবীদের বাণী হিসেবে অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, কিয়ামতের দিন সন্তানরা পিতামাতার পেছনে লেগে থাকবে। তারা চিৎকার করে বলবে, হে পিতা, আপনি আমাকে ধ্বংস করেছেন কেন?!! তারপরও কিভাবে পিতা-মাতারা কলিজার টুকরা সন্তানদের জাহান্নামের জ্বালানি হিসেবে বেড়ে উঠতে দেন?!! বরং তারা জাহান্নামে পৌঁছার সব সামগ্রী তাদের জন্য ক্রয় করে দেন। এমনটি হবার কারণ সাধারণ পিতা-মাতার ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা আর যারা ইসলাম সম্পর্কে জানেন, তাদের ইসলামের নির্দেশনা মতো সন্তানের লালন-পালন সম্পর্কে না জানা। এর সিংহভাগই সন্তানের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে। এ কারণেই পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক দায়িত্ব, যা সীমাহীন গুরুত্বের দাবি রাখে। তাই মুসলিম নর-নারীকে এ দায়িত্বের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত। মুসলিম বিদ্যালয়গুলোর কর্তব্য আগামী প্রজন্মকে এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলা। তাদেরকে এ দায়িত্বের সঙ্গে যথাযথভাবে পরিচিত করা।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর হাদিসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে কখন সন্তানকে সালাতের নির্দেশ দেয়া হবে:
🔵 সাবরা বিন মা‘বাদ জুহানী থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘বাচ্চাদের সালাতের নির্দেশ দাও, যখন তাদের বয়স হয় সাত বছর এবং যখন তাদের বয়স দশ বছর হয় তখন এ জন্য তাদের প্রহার।’ 📚(আবূ দাউদ:৪৯৪)
🔵 আমর বিন শুয়াইব তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, তোমাদের সন্তানদের সাত বছর হলে তাদের সালাতের নির্দেশ দাও, তাদের বয়স দশ বছর হলে এ জন্য তাদের প্রহার করো এবং তাদের পরস্পরে বিছানা পৃথক করে দাও।' 📚(আবূ দাউদ:৪৯৫; মুসনাদ আহমদ:৬৬৮৯)
🔵 মু‘আয বিন আব্দুল্লাহ বিন হাবীব আল-জুহানী সূত্রে হিশাম বিন সা‘দ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিনি তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, শিশু কখন সালাত আদায় করবে? তিনি বললেন, আমাদের এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে বলতেন তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিল। এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘যখন সে তার ডানকে বাম থেকে আলাদা।’ 📚(আবূ দাউদ:৪৯৭; বাইহাকী, সুনান আল-কুবরা:৫২৯৬)
🔶‘অর্থাৎ শিশু যখন ডান ও বামের মাঝে পার্থক্য করতে পারবে। আর সাধারণত এ যোগ্যতা সপ্তম বছরে পৌঁছার পরই হয়।’ 📚(আউনুল মা‘বুদ:২/১৬৫)

🔵 আব্দুল মালেক বিন রবী‘ বিন সাবরা তার বাবা থেকে এবং তিনি দাদা সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘বাচ্চাকে সালাত শিক্ষা দাও যখন সে সাত বছর বয়সী হয় এবং এর জন্য তাকে প্রহার করো যখন সে দশ বছর বয়সী হয়।’ 📚(তিরমিযী:৪০৭; ইবন খুযাইমা:১০০২; তাবরানী, আল-মু‘জামুল:৬৪১৮)
🔵 আমর বিন শুয়াইব তার পিতা থেকে এবং পিতা দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘সাত বছর বয়সে তোমাদের সন্তানদের সালাতের নির্দেশ দাও এবং দশ বছর বয়সে এর জন্য তাদের প্রহার করো আর তাদের শোয়ার স্থান পৃথক করে দাও।' 
📚(আহমদ:৬৭৫৬, আবু দাউদ:৪৯৫)

🔵 আবূ রাফে‘ (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর ওফাতের পর আমরা তাঁর তাতে লিখা আছে : পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে, সাত বছর বয়সে ছেলেদের ও মেয়েদের এবং ভাইদের ও বোনদের বিছানা আর তোমাদের সন্তানদের সালাতের জন্য প্রহার করো যখন তারা (আমার ধারণা তিনি বলেছেন) নয় বছরে পৌছে।' 📚[মুসনাদ বাযযার:৩৮৮৫]
বলাবাহুল্য যে শিশুকে সালাতের নির্দেশ দানের আগে তাকে তা শেখাতে হবে। সে যা চেনে না আমরা তার নির্দেশ দেই কী করে? তাইতো ইবন আবিদ্দুনইয়া (রহ.) আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা:) সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, তিনি শিশুদের সালাত শেখাতেন যখন তারা ডান থেকে বাম শিখত। জুনদুব বিন আবী ছাবেত থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (সাহাবীদের) শিশুরা যখন বিশ পর্যন্ত গুনতে শিখতো তখনই তাঁরা তাকে সালাত শিক্ষা দিতেন। 📚(আল-ইয়াল:১/৪৭৩।)
শিশু পঞ্চম বছরে পৌঁছলে তাকে অযূর ফরয, সালাতের রুকন শেখাতে হবে। সূরা ফাতিহা মুখস্থ করাতে হবে। রুকূ‘ ও সিজদা শেখাতে হবে। শিশু হলো আদর্শ অনুকরণকারী। সে যখন তার পিতামাতাকে সালাত আদায় করতে দেখবে, তখন সেও তাদের অনুকরণ করতে শুরু করবে। এ জন্য পিতামাতার উচিত নিজেদের সালাতকে শুদ্ধ করা এবং সুন্নত তরীকায় ও সঠিক পদ্ধতিতে সালাত আদায় করা। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে সঠিক পদ্ধতিতে নিজে সালাত আদায় করা এবং সন্তানদের সালাত শিক্ষা দেবার তাওফীক দান করুন। আমাদের সন্তানগুলোকে সাহাবীদের সন্তানের মতো আদর্শ মানুষ বানিয়ে দিন। আমীন।
.
.
.
লেখক : আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. মো: আব্দুল কাদের
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

No comments:

Post a Comment